মাতৃ দিবস



“দশটা পাঁচ মিনিটের ব্যান্ডেল লোকাল তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে”। এই কথা গুলো কানে আসবার পরই অনেক লোক ছুটতে শুরু করলো তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। আমিও ছুটতে শুরু করলাম। এর পরে আবার কখন ট্রেন কে জানে? ছুটতে গিয়ে দেখলাম আমার জামা টেনে ধরলো পেছন থেকে কেউ। দাঁড়িয়ে পড়লাম। অনেক সময় পকেট মারের কারসাজি থাকে। পিঠে পাঁচ কিলোর বাটখারার মতো ঝুলছে ল্যাপটপ। অনেক সংশয় নিয়ে ফিরে দেখি সামনে কোথায় কে? একটু ঝুঁকতেই ঠিক হাঁটু বরাবর একটা বছর চারেকের মেয়ে। মাথা নেড়া। কানে আবার দুটো দুল। পায়ে হাওয়াই চপ্পল। পরনের জামা রঙ ওঠা কিন্তু ময়লা নয়। চোখ গুলো গোল গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে। ভিক্ষে চাইছে নাকি? না, তেমন তো মনে হচ্ছে না। হাওড়া স্টেশনে যে বাচ্চারা ভিক্ষে করে ঠিক তাদের মতো নয়। সেই ছোট্ট মেয়েটা ততক্ষণে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো। “ও কাকু...ব্যানতেল লোতালটা কুখান থেকে ছাড়বে গো?” আমি অবাক। একা নাকি মেয়েটা? হারিয়ে যায়নি তো? বাড়ি থেকে পালিয়েছে? জনপ্রিয় ও ক্লিশে এবং বোকা ভাবনা যা আসতে পারে মনে মনে যখন সেইসব মনোলগের মতো সাজাচ্ছি ঠিক তখনি মেয়েটি আবার বলে ওঠে “ও কাকু...ব্যানতেল লোতালটা...”আমি বললাম ওই তো তিন নম্বর...। মেয়েটা বলে ওঠে “আমি তি পড়তে পারি? কুখান থেকে ছাড়বে বলো”। আমি দেখালাম ওই তো...। ওই প্ল্যাটফর্ম। মেয়েটা দেখি সেই প্ল্যাটফর্মের দিকে না গিয়ে উলটো দিকে হাঁটছে। আমি ব্যাপারটা কি হলো দেখতে গিয়ে ছুটলাম পুঁচকে মেয়েটার পেছনে। কিছুটা এগোতেই থমকে দাঁড়ালাম। সেই মেয়েটা এগিয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞের মতো। তার হাত ধরেছে পেছনের এক মহিলা। সেই মহিলার হাত ধরেছে আর এক পুরুষ। দুজনের হাতেই নানা রকমের নিন্মবিত্ত সংসারের পোঁটলা পুঁটলি। ঘর গেরস্থালির সরঞ্জাম। কোথা থেকে ফিরছে তারা...হয়তো কোথাও যাচ্ছে। আর হাজার লোকের ভিড়ের মাঝে সেই মেয়েটা বলে যাচ্ছে “এততু সরে...ও দিদা...এততু সরে যাও...। ও কাকু...এততু সরে...। বাবা মা দেততে পায় না।” তার সামনের ভিড়টা সে তার ছোট্ট হাত দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর পেছন থেকে হাত ধরা মহিলা বলে যাচ্ছে। ও চুটকি...ট্রেনে কি ভিড় মা?...পেছন থেকে বাবা বলছে ও চুটকি লাল আলো কি সবুজ হয়েছে? তাড়াতাড়ি কর...। চুটকির কোনো দিকে খেয়াল নেই...চুটকি এগিয়ে যাচ্ছে ছোট্ট হাত দিয়ে ভিড় সরাতে সরাতে দুজোড়া অন্ধ চোখের পাশে দেখতে পাওয়ার এক ছোট্ট আশা নিয়ে। আমি পিছু নিলাম দূর থেকে। যতক্ষণ না চুটকি তার বাবা-মাকে পথ দেখিয়ে ট্রেনের কামরায় তুলে দেয়। যতক্ষণ না দরজার কাছে বসার জায়গা করে দেয়। যতক্ষণ না লিলুয়া পেরোতে না পেরোতেই মায়ের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। উত্তরপাড়া স্টেশনে নেমে দেখতে পেলাম বাজারের লাগোয়া কোনো এক দোকানের বাইরে একটা টি শার্ট ঝুলছে। তাতে গোটা গোটা করে লেখা “মা তুঝে সালাম”। ঠিক তখনি প্রশ্নটা মনে এলো সালাম করলেই মায়ের ঋণ কি শোধ করা যাবে? যার জন্য এই দেহটা পেয়েছি... চুটকি যার জন্য দেখতে পাচ্ছে আর পথ দেখাচ্ছে...যে ভাতের থালা হাতে নিয়ে পেছনে পেছনে ছুটেছে। বাড়ি না ফিরলে রাত জেগে বসে থেকেছে দোর গোড়ায়। সেই মাকেই চাকরী করার অছিলায়...। সময়ের নিছক অভাব দেখিয়ে, মিথ্যে বলে দেখা না করে থেকেছি দিনের পর দিন। মাসের টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ত্ব সেরেছি। আর ক্যালেন্ডারের একটা দিন দাগিয়ে গাল ভরা নাম দিয়েছি ‘মাতৃ দিবস’। দেখা করার বদলে কার্ড আর ফুল পাঠিয়েছি দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। নিজে অপরাজিত থেকেছি। আর সর্বজয়াকে মরতে হয়েছে গাছের তলায়। পুকুর পাড়ে। বহুতল ফ্ল্যাটের বদ্ধ ঘরে। একরাশ অভিমান নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের অন্ধকারে। আর দোকান গুলো ভরে উঠেছে মাকে ভালোবাসার নানান কোটেশানে, কাপে, টি-শার্টে বাণিজ্যের হরেক রকমবায়। আসলেই আমরা মাকে বিক্রি করে দিয়েছি ভালোবাসা সমেত

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি