বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে

একদিন অনেক রাতে বালীর বাসায় এগারো জনের পাত পাড়ার আগে কোনো এক বসন্তের লোড শেডিং করা আবহে বাবা চাদরের মধ্যে থেকে বের করেছিলো একটা চটি বই। শিক্ষক মানুষ, বই তো হামেশাই নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। ব্যাগের মধ্যে থাকে। আমাদের সেই আদ্দিকালের উদ্বাস্তু শিবিরে দেওয়াল ভর্তি বই। নোনা ধরা দেওয়ালে যাদের দিকে তাকালে আমার গায়ে জ্বর আসতো আর দাদা মাথায় জবজবে তেল মাখা চুল পরিপাটি করে লাইব্রেরী লাইব্রেরী খেলতো।
তার ইচ্ছে ছিলো বড় হয়ে একটা বিরাট গ্রন্থাগারে কাজ করবে। 'গ্রন্থাগার' শব্দটি লিখেই মনে পড়লো অনেক দিন আগে মৃত এক মানুষের কথা। গুরুচন্ডালি এবং ইংরাজী বাংলা মিলিয়ে লিখলে যে ভীষণ চটতো আর আমি মোটেই তোয়াক্কা না দিয়ে মণি মানে আমার পিসির পাশে চুপটি করে গিয়ে সেঁধুতুম। সেই লোকটাই যখন শুভ্র চাদরের নিপাট ভাঁজ থেকে একটা বই বের করে আমাকে ডাকলেন "টুকনু"...আমি তখন ব্যাজার মুখ করে মণিকে চিমটি কাটি। "এই তো পড়া থেকে উঠলাম...এখনি আবার পড়া? শুনছো না ওপাশের কণ্টিদের বাড়ি থেকে কি সুন্দর ভেসে আসছে রেডিওর হিন্দি গান?" মণি চোখ টেপে। মানে চুপ। রান্নাঘরের লম্ফ নিভিয়ে উঠোনে এসে জড়ো হয় এক সময়ের দেশ ছাড়া, মাটি ছাড়া মানুষ গুলো। এরপর কিছুদিন বাবাকে আমরা পাবো না। ভর্তি হতে হবে স্বাস্থ্য শিবিরে। কারণটা আমি জানি। লুকিয়ে দেখেছি কাশির সাথে উঠছে রক্ত। অনেক বন্ধু তাই আমার সাথে খেলে না। বাবার অনেক বন্ধু এখন আর আমাদের বাড়ি আসে না। কাছের আত্মীয়রাও অনেক দূরে সরে। সেই নির্বান্ধবপুরে... সেই আঁধারে...রাতের খাবার আগে...এক স্বাস্থ্য শিবিরে যাওয়ার আগে আমার ক্ষয়াটে শ্বেত শুভ্র চাদরে ঢাকা বাবা শোনালেন...উচ্চারণ করলেন...এক কবিতা...। "বাংলাভাষা উচ্চারিত হলে"। আমাদের বালীর উঠোন কোথা থেকে জ্যোতস্নায় ভেসে গেল...দাদা তার সদ্য ওঠা গোঁফটার গাম্ভীর্য কোথায় যেন হারিয়ে ফেললো। ঠাম্মা দুধহীন একাদশীর কথা ভুলে গিয়ে চেয়ে রইলো ছানি পড়া চোখে দূর অলক্ষ্যে। মণির চোখ বেয়ে নেমে এলো করুণাধারা...। এখোনো এতোদিন পরেও চোখ বন্ধ করলে সেই দৃশ্য আমি দেখতে পাই। ভুলিনা...ভুলতে পারিনা কোনোদিন। কারণ সেই দিনটা আমার কাছে একুশে না হয়েও অমর একুশে...। শামসুর রহমানের কবিতাটা তাই আমার কাছে বেদ মন্ত্রের মতো। চোখ বন্ধ করে সেই সব মানুষকে ফিরে পাওয়া যারা কোচড়ে করে নিয়ে এসেছিলো দেশের মাটি। দেশের ভাষা। অথচ যাদের কাছে দেশ বলে...ভাষা বলে কোন পরিসরই মুক্ত ছিলো না কোনোদিন।

বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে
রোদ , বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন । বাংলা ভাষা
উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে , খোলা পথে , উত্তাল নদীর
বাঁকে বাঁকে , নদীও নর্তকী হয় ।যখন সকালে
নতুন শিক্ষার্থী লেখে তার বাল্যশিক্ষার অক্ষর ,
কাননে কুসুম কলি ফোটে , গো রাখালের বাঁশি
হাওয়াকে বানায় মেঠো সুর , পুকুরে কলস ভাসে ।
বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে চোখে ভেসে ওঠে কত
চেনা ছবি ; মা আমার দোলনা দুলিয়ে কাটছেন
ঘুম পাড়ানিয়া ছড়া কোন সে সুদূরে ; সত্তা তার
আশাবরী , নানী বিষাদ সিন্ধুর স্পন্দে দুলে
দুলে রমজানী সাঁঝে ভাজেন ডালের বড়া , আর
একুশের প্রথম প্রভাত ফেরী-অলৌকিক ভোর । 


'আমার ব্লগ'-এ প্রকাশিত। ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি