বাড়ির নাম কণিকা
একটা বই একটা গোটা মাস কেড়ে নিয়ে
কখোনো এমন ভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেনি। একটা বই আগে কোনোদিন এমন ভাবে বলেনি,
বাংলার হরফে যা পড়লে বাংলা সাহিত্যে শুধু তা প্রথম নয় একেবারেই বিরল। শুধু
বাংলা সাহিত্যে কেন? বিশ্বের সাহিত্যের ভান্ডারে এই বই খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। এক
মা লিখছেন যুদ্ধের দিনলিপি। এক মা লিখছেন এমন এক নিদারুণ সময়ের কথা, ব্যাথার কথা,
আনন্দের কথা যা পড়তে বসলে আজ এতোদিন পরেও স্থির থাকতে পারাটা দুষ্কর।
আপনি “একাত্তরের দিন গুলির” কথা
বলছেন দাদা?
আমার হাতে মেলা বইয়ের আধখোলা অংশ।
আমার পাশে হীরক। স্ব-প্রশ্নে তাকিয়ে
আমার দিকেই। তারপাশে ফাহমিদ। আর একদিকে নাসিমূল। উলটো দিকে সানি, একটু দূরে
জুনায়েদ। রাজীব আরো অনেকটা দূরে চেয়ার নিয়ে ঘুরে বসেছে আমাদের দিকে। এনা এই
মুহূর্তে লেখা থামালো। বাইরে শ্রাবণের বৃষ্টি। সকাল থেকে একটানা। চোখ বন্ধ করলে
সেদিনটা আমি আজও যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। এসি মেশিনের টানা এক ঘিরঘিরে শব্দ...। হাত
পা ঠান্ডা হয়ে আসা জলীয় আস্তরণ...আর সেইসবের মধ্যে আমরা যেন উপলব্ধি করি, আমাদের
অফিসে কোথাও কোনো এক নিভৃত কোণে, লেখার সরঞ্জামের পাশে... ফাহমিদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে
রাখা টেবিলে কিম্বা, লীনার মহা ব্যাস্ততার মধ্যেও এক মা অনেকক্ষণ থেকেই শুধু না,
বেশ কয়েকদিন ধরেই আমাদের সাথে আছেন। থাকছেন। কথা বলছেন। আমরা অবাক হয়ে শুনছি তার
কথা। কখোনো চোখ ভিজে আসছে নোনা জলে। একটা
বই গড়িয়ে গিয়ে পড়ছে আরো একটা বইতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বই দিয়ে যাচ্ছে রকমারি থেকে
সেই ছোট্ট ছেলেটা। দুপুরের ফ্রাইড রাইস আর চিকেন জুড়িয়ে যাচ্ছে টিফিন কৌটোতে।
পিউয়ের আনা পিঠে হাতে হাতে ফুরিয়ে যাচ্ছে। দুপুরের মতো বিকেল গড়িয়ে শেষ হচ্ছে
বর্ষার সেই ক্ষীণ আলো। আমরা ঠিক করছি তাহলে কি আজই বেরিয়ে যাই? গুনগুন করে উঠছে
ঘরটা। এলিফ্যান্ট রোড তো কাছেই। তবু বৃষ্টি। জ্যামজট। অনিশ্চয়তা, চায়ের কাপে
ধোঁওয়া ওঠা বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। যাওয়া হয় না আমাদের। বৃষ্টি আরো বাড়ে। আমরা কোনো মতে
যে যার মতো বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। জুনায়েদ বলে দেয়, আগামীকাল ঠিক যাবো দাদা।
বৃহস্পতিবার তো। শুক্রবার অফিস ছুটি। কাজেই আর কোনো চিন্তা নেই। ঠিক যাবো কাল।
ছাতাহীন জুনায়েদ ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মিশে যায় ধানমন্ডির সন্ধ্যাকালীন জ্যামে।
“হঠাৎ ভয়ানক একাকী নিঃসঙ্গ মনে হল
নিজেকে। মুহূর্তেই মন চলে গেল বিশ-ত্রিশ বছর আগেকার স্মৃতিতে। বাবা, মা, ভাই-বোন,
স্বামী, সন্তান-সকলের মুখ যেন মনের পর্দার সামনে দিয়ে ভেসে ভেসে গেল। বাবা মারা
গেছেন ১৯৬৬ সালে, হার্ট অ্যাটাকে। স্বামী ও জ্যেষ্ঠ সন্তান হারিয়েছি একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। মা গেলেন ক্যান্সারে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে। মায়ের
ক্যান্সার হবে, একথা কেউ অতিবড় দুঃস্বপ্নেও ভাবেতে পারিনি। গলব্লাডার অপারেশনের পর
মায়ের স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যায়। তাহলে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে মায়ের কোলোনে কেন
ক্যান্সার বাসা বাঁধল ? ডাক্তাররা বলেন ক্যান্সার কেন হয়, কিসে হয়, এখোনো বের করা
সম্ভব হয়নি। তবে তারা অনেক গুলো কারণকে সন্দেহ করেন। তার মধ্যে কয়েকটা হল
নিঃসঙ্গতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অসহনীয় তীব্র শোক ও দুঃখ। তা মা জীবনে কম তীব্র শোক
পাননি। ১৯৬৪ সালে আমার ভাই চাঁদ মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়।
...মা মানসিক ভাবে আমার স্বামী শরীফ এবং বড় ছেলে রুমীর ওপর খুব বেশী নির্ভরশীল হয়ে
পড়েন। সেই শরীফ আর রুমী যখন হারিয়ে গেল যুদ্ধের ডামাডোলে- সেই আঘাত আর তিনি সহ্য
করতে পারলেন না। আমিও কি মায়ের পথেই চলেছি?” (ক্যান্সারের সাথে বসবাস/জাহানারা
ইমাম সমগ্র/পৃষ্ঠা-৪০৪-৪০৫) নিজের জীবনে সবচেয়ে বড় অপারেশানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি
লিখেছিলেন এই কথাগুলো। ভয়ে? না সেটা কখোনোই নয়। এই মা যতটা ভয় পান তার থেকে বেশি
এগিয়ে যান নির্ভয়ের সেই রাস্তায়। জীবনের তীব্র দহন, শোকে তিনি আরো মরিয়া হয়ে
উঠেছিলেন অন্য কাজের সৃষ্টিশীল উল্লাসে। তাঁকে লিখতে হবে একাত্তরের দিনলিপি।
ক্যান্সারের সাথে সহবাসের আর একটু পর থেকেই তার সব কিছু অসুস্থতা ছাড়িয়ে যে দিনগুলো
এগোবে এক মহৎ কাজের দিকে। এক মা লিখে চলেছেন তার ছেলেকে হারিয়ে ফেলার গল্প। যে মা
বলছেন তাঁর বড় প্রিয় অন্দরের কথা... স্বাধীনতার কথা...মুক্তির যুদ্ধে তাঁর ছেলেদের
বীরত্ত্বের কথা...। যে বই প্রকাশিত হবার পর সাড়া পড়ে যাবে গোটা দেশে। আর অনেক দিন
পর। অনেক টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে, অনেক আলোকবর্তিকা পেরিয়ে আমি যখন বাংলাদেশের
মাটিতে পা দেবো, তারও অনেক পরে এসে পৌঁছবে আমার হাতে এই বই। ততদিনে বইয়ের কভারে
উজ্জ্বল অক্ষরে প্রকাশিত একটা কবচ “ রজত জয়ন্তী সংস্করণ”।
সারা রাত ঘুম হয় না আমার। আসলেই আমরা
একটা বাড়ি খুঁজতে চলেছি। আমরা চলেছি সেই মায়ের বাড়ি যে মা একদিন বলেছিলেন সেইসব
মানুষদের শাস্তি চাই যারা দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে শত্রুতা করেছে। যারা ছিনিয়ে
নিয়েছে অসংখ্য দেশবাসীর প্রাণ। যে মা একাত্তরের যুদ্ধে হারিয়েছেন তার বড় ছেলে আর
স্বামীকে। যে মা তিলেতিলে জমিয়ে রেখেছেন এক বুক দুঃখ...দুই মলাটের বইতে ঢেলে দেবেন
বলে। “ ডিসেম্বরের তিন তারিখে গাজী আমার বাসায় এসে বললো, ‘আপনার একটা ডায়রী আছে না
একাত্তর সালের? ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুটো লেখা লিখে দিন না দিনিলিপির
আকারে। সন্ধানীতে দুই সংখ্যায় ছাপবো।’ হ্যাঁ, একাত্তর সালের লেখা ডায়রীটা এখনও আছে
আমার কাছে। মাঝে মাঝে ভেবেছি রুমীর কথা লিখবো। কিন্তু লিখবার আগে পুরো ডায়রীটা পড়ে
নিতে গিয়ে শোকে দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়েছি। লেখা আর হয়ে ওঠে নি। এখন এই বছরে হঠাৎ
মনের মধ্যে লেখার জোয়ার এসেছে। তাই গাজীর প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। সচিত্র সন্ধানীর
একটা সংখ্যা বেরোবে ৯ ডিসেম্বর, পরবর্তী সংখ্যা ১৬ ডিসেম্বর। আজ ৩...”
(ক্যান্সারের সাথে বসবাস/ জাহানারা ইমাম সমগ্র/ পৃষ্ঠা-৪২২)
বৃষ্টি ধরে আসে না। কাঁচের জানলায়
বৃষ্টির ছাঁট পাঁচতালার আমার ছোট্ট কামরায় বিন্দু বিন্দু জলের আবরণ তৈরী করে। গভীর
রাতে ঘুমোতে গিয়ে মনে মনে বলি “বাড়ির নাম কণিকা”। যে বাড়িতে খাটের পাশে রাখা এখোনো
অনেক গুলো রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট। বিছনার চাদর পরিপাটি করে পাতা। মনে হয়
এক্ষুনি কেউ গুছিয়ে রেখেছে। পরনের শাড়ি, লেখার খাতা, পড়ার বই সব যেমন ছিল তেমনটাই।
এই বাড়িতে...এই পাড়ায় দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পর অসুস্থ অপটু শরীরে ফিরতে চাইছেন এক
মা। আর এই বাড়ি তো শুধু বাড়ি নয়, স্বাধীনতার আর এক জ্বলন্ত ইতিহাস। “ ওদের
কী করে বোঝাবো এত সুন্দর, পরিষ্কার, ছবির মতো দেশে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি।
এখানে কোলাহল নেই, বাচ্চাকাচ্চার চেঁচামেচি নেই, রাস্তায় ভিড় নেই, গলিতে
ফেরিওয়ালার হাঁক নেই, দরজায় ফকিরের ঘ্যানর ঘ্যানর নেই। এখানকার পড়শিরা যখন তখন হুট
করে বিনা টেলিফোনে এসে পড়ে না, পথ হাঁটতে গেলে প্রতি পদে রিক্সা এসে পথ অবরোধ করে
না। ঢাকার বাড়ির চারপাশে পাড়ার বাচ্চাদের ছোটাছুটি চিল্লাচিল্লির জ্বালায় কোনোদিন
দুপুরে ঘুমোতে পারিনি, অসময়ে মেহমান আসার জ্বালায় কতদিন কত কাজ বাকি থেকেছে,
ফেরিওয়ালা আর ফকিরের হাঁকের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি; এখন এই জ্বালা গুলোই আমাকে
চুম্বকের মতো টানছে। ওইগুলির অভাবে এখানে এই শান্তিময়, সৌন্দর্যময়, সভ্যভদ্র জগতে
আমার প্রাণ খাবি খাচ্ছে। ...আমারো দরকার খুব সুন্দর কোলাহল। মনোমুগ্ধকর হৈ চৈ। তার অভাবে আমার এই দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী আর
কাটে না। (ক্যানসারের সাথে বসবাস/জাহানারা ইমাম সমগ্র/ পৃষ্ঠা-৪১৪-৪১৫)
কেন কণিকা যেতে চাইছি আমি? আমি কি
খুঁজে আনতে চাইছি সেই মাকে যে একদিন তার বড় ছেলের গেরিলা হবার প্রস্তুতি
লিখেছিলেন? যে বাড়িতে, গলিতে অনেকটা সময়ের ইতিহাস ছায়া ফেলে আছে? নাকি সেই পূণ্য
পরিবারের উঠোনে একবার দাঁড়াতে চাইছি যারা দেশের বড় দুর্যোগের দিনেও এগিয়ে দিয়েছেন
নিজের খুব তরতাজা প্রাণের আহুতিকে? কিন্তু গোটা দেশ খুঁজলে এমন আদর্শ তো অনেক
পাওয়া যাবে। হ্যাঁ তা গেছেও। শহীদ জননীর অন্যান্য লেখায় তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট।
ইতিহাসও তার সাক্ষী। হয়তো আমি কোনো
অন্দরের গল্প শুনতে চাইছি। আমি এক মায়ের কথা শুনতে চাইছি। যে মা লিখে যাচ্ছেন
দিনলিপি ইতিহাসের পাতায়। তার ঘর কন্নায় ধরা পড়ছে দেশের...সমকালের...বিচ্ছেদের এক
অন্যরকম রঙ। যে রঙে আরো অনেকদিন পর আমি আরো এক মাকে খুঁজে পাবো। আনিসুল হকের দুই
মলাটের লাল প্রচ্ছদের মা জ্যান্ত মা হয়ে উঠবে। অনেক রাতে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে দেবে।
আমাকে ভাবাবে সত্যিই আজাদের বাড়িটা কোথায়? গভীর রাতে হীরককে ফোন করলে হীরক বলবে খুঁজে
দেবে আজাদের বাড়ি। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। এখন এই মুহূর্তে একজন মা যখন
লিখছেন তার বড় ছেলের গেরিলা হবার প্রস্তুতি...। একজন স্ত্রী যখন লিখছেন শিবপুর
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, সরোদ বাজাতে পটু, দেশের জন্য নিবেদিত
প্রাণ স্বল্পভাষী স্বামীর গুমড়ে গুমড়ে মরার কষ্ট...। একজন পুত্রবধূ যখন জানতে দিতে
চাইছেন না তাঁর বৃদ্ধ অন্ধ শ্বশুরকে শহরে যুদ্ধের অবরুদ্ধ অবস্থা তখন সেই মা, সেই
স্ত্রী, সেই পুত্রবধূ কোথাও যেন বইটার সাথে জীবন্ত হয়ে যাচ্ছেন। আমরা হাঁটছি ফাস্ট
পার্সন ন্যারেশানে।
এক মহিলা এই বইটির কেন্দ্রবিন্দুতে
কাহিনীর, আখ্যানের, হৃদয় বিদারক যে সত্য ঘটনার প্রাণ প্রদীপ জ্বালান তা চিরতরে
বাংলা সাহিত্যের এক সেরা সম্মানের অংশীদার করে তোলে পাঠককে। এবং তার সাথে কোথাও
প্রজ্জ্বলিত হয় তার নিজের বৌদ্ধিক এবং চিন্তন জগতের এক অন্য ছায়াছবি। একাত্তরের
দিনগুলি বাংলা সাহিত্যে শুধু অগ্রজ নয়, বিরলতম এক সংযোজন বলে আমি নিজে বিশ্বাস
করি। বাংলার যুদ্ধ উপন্যাস খুবই কম। নেহাতই হাতে গোনা। বাঙালী যুদ্ধে যাবার সাহস
দেখায়নি স্বাধীনতার সময়। এটা লেখার পরেই যাঁরা আমাকে তেড়ে মারতে আসতে চাইবেন তাদের
বলি যে কতিপয় বাঙালী সাহস দেখিয়েছিল তাদের হয় মারা হয়েছে। চোর, স্বদেশী ডাকাত,
টেররিস্ট বলে উৎখাত করা হয়েছে। সহিংস্রতার বদলে ইংরেজ প্রভুদের গালে চুমু খেতে বলা
হয়েছে। কিম্বা দেশের বাইরে থেকে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে আসা এমন এক বাঙালী বীর নায়ককে
এমন এক উড়ো জাহাজে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যে উড়ো জাহাজ আর কোনোদিন ভারতের দিকে একবারের
জন্যও ফিরে আসতে পারেনি। অনেক আগেই বাঙালীকে কেরানী করে রাখা হয়েছিল। এবার
স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশটা ভাগ করে তাদের মেরুদন্ডটা ভেঙে ফেলা হল। কিন্তু
যুদ্ধটা একটা সময় বাঙালীকে করতেই হলো। তার মাতৃভাষার জন্য। তার মাথা উঁচু করে
দাঁড়াবার জন্য। এবার সত্যি সারা বিশ্ব দেখলো একটা ভাষার জন্য একটা গোটা জাত কীরকম
মরিয়া হয়ে ওঠে। এবার বিশ্ব শুনলো ভাষার জন্য একটা রাষ্ট্রের দাবী। এবার বিশ্ব
জানলো বাঙালীরাও লড়তে পারে।
সবে সন্ধ্যে নামছে আমরা কয়েকজন
ধানমন্ডি থেকে রিক্সা নিয়ে এলিফেন্ট রোডের পেট্রোল পাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।
সানি আর ফাহমিদ বয়সে সবার ছোট। তারা সামনের গলিটা দিয়ে ঢুকে এসে জানালো...
“দাদা...এখানে তো বলছে কেউ নাম শোনেনি...। চেনে না।” আমি একটু এগিয়ে গেলাম গলিটা
দিয়ে। হ্যাঁ...এটা তো একটা কানা গলি। বাড়িটা ছিল ঠিক কানা গলির শেষ সীমানায়। গাড়ি
শেষ পর্যন্ত ঢুকতো না। গাড়ি ঘুরিয়ে আনা হতো। ফাহমিদ বললো “কী পরীক্ষায় ফেললেন বলুন
তো?” আমি ধমকাই দাঁড়া। হীরক আর জুনায়েদ এক্ষুনি এসে পড়বে। আমরা ঠিক খুঁজে পাবো
রুমীর বাড়ি। একদম ছটফট করিস না। পাশ থেকে এনা বললো চলুন দাদা, ...চা খাই। আমাদের
চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই চলে এলো হীরক আর জুনায়েদ। শহরের এমন এক কেন্দ্রে নিজেদের
বাড়ির অবস্থান, এমন এক সমাজের পরিসরে তাঁদের বসবাস সেখানে সেই সময়ের এমন কোনো
গুণীজন ছিলেন না যাদের আসা যাওয়া হয়নি। একটা ভাষার জন্য একটা দেশকে নতুন জন্ম দিতে
যে মা হারালেন চিরকালের জন্য তার ছেলেকে...স্বামীকে... সেই মা যখন অনেক দিন পর
ফিরে দেখেন তাঁর ছেঁড়া পাতার ডায়রী তখন কান্না চেপে রাখতে পারেন না। কারণ ততদিনে
তাঁর দেহে বাসা বেঁধেছে মারণ ক্যানসার। কিন্তু তিনি তো মা। যাকে সবাই পরবর্তীকালে
শহীদ জননী বলে এক ডাকে চিনবে। শ্রদ্ধা জানাবে। শাহবাগে লক্ষ জনস্রোতের মাঝে উড়বে
তার হাসি মুখের নিশান। তিনি কি তাঁর রুমীর জন্য লিখবেন না? যে রুমীকে উনি মত দিতে
পারছিলেন না যুদ্ধে যাবার জন্য? যে রুমী একদিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আম্মা
দেশের এই অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও আমি হয়তো যাবো শেষ
পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা
থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে
কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?” (একাত্তররে
দিনলিপি/ জাহানারা ইমাম/ পৃষ্ঠা-৬৬)।
না এই গলিটা না। এখানে কণিকা নামের
কোনো বাড়ি নেই। আর থাকলেও তা ভাঙা হয়ে গেছে শহরের অনেক পুরোনো বাড়ির মতো। এক
দর্জির দোকানের কর্মী জানায় আমাদের। জুনায়েদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরে অনেক
আশা নিয়ে বলে হতেই পারে না দাদা। আমরা ভুল গলিতে এসেছি। এমনটা কী করে হবে? নামে
চিনতে পারছে না? শাহবাগের ঘা এখোনো শুকোয়নি...। আমরা অন্য আর একটা পেট্রোল পাম্প
আছে। ফিরতি পথে। ওই দিকে যাই। আমরা সবাই অনুসরণ করলাম জুনায়েদকে। সানি আর ফাহমিদ
অস্থির। নাসিমূল বরাবরের মতো চুপ। রাজীব মাথা নীচু করে হাঁটছে। এনা আমার পাশে...
ঠিক কয়েক কদম পেছনে। হীরক এসে পাশে হাঁটতে থাকলো। বারবার বললো...এতোদিন ঢাকা
থাকা হয়ে গেল দাদা...। কেন একবারও রুমীর বাড়ি দেখতে আসিনি এর আগে? বর্ষার ভ্যাপসা
সন্ধ্যে জনা কয়েকের মিছিল অগ্রাহ্য করলো। যারা সত্যি খুঁজছে কণিকা
নামের বাড়িটা। যারা খুঁজছে সেই মাকে, যে মা একদিন অনেক মায়ের মতো তার ছেলে রুমীকে
বলেছিলেন, “ ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা
তুই যুদ্ধে যা।”
যুদ্ধ এখন নেই। চারিদিকে শান্তি। আর
সেই শান্তির সন্ধ্যে বলছে এই পথ দিয়ে কত দিন আগে রুমী হাঁটতো...। এই পথ দিয়ে
শেষবারের মতো শত্রুপক্ষ তাকে তার মায়ের সামনে থেকে নিয়ে গিয়েছিল। মায়ের ছেলে আর
ঘরে ফিরে আসেনি। সন্ধ্যার গাঢ় হওয়ার...জমাট বাঁধার সব আয়োজনের মাঝেও আমাদের চলা
থামে না। একটা গলির কাছে থমকে দাঁড়ায় জুনায়েদ। গলির দেওয়ালে একটা ছেঁড়া ফ্লেক্সে
লেখা শহীদ জননীর বাড়ি। তীর চিহ্নটি ম্রিয়মান হলেও...আমাদের মনে এক অন্য ধরনের উথাল
পাতাল। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমরা কী সত্যিই কণিকার সামনে? (ক্রমশ)
কৃতজ্ঞতা-
বই- একাত্তরের দিন গুলি। ক্যান্সারের সাথে বসবাস। জাহানারা ইমাম সমগ্র। জাহানারা ইমাম।
ছবি- গুগুল ইমেজ
হীরক, নাসিমূল, ফাহমিদ, জুনায়েদ, সানি, রাজীব, এনা, পিউ, লীনা, শারওয়ার, অমলদা, রাকিন। আমার লেখক বন্ধুরা।
দাদা, স্মৃতিগুলো আবার উসকে গেল। এবার কণিকায় যাবার পালা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি... কারণ আমরা জানি এরপর কী হয়েছিল অথচ যেন জানি না। লেখক যা জানেন, যা দেখেন তা দেখার একটা অন্যমাত্রা আছে। আপনার সাথে আবার নতুন করে সব দেখব এমন একটা সাধ জ্বলজ্বল করছে।
উত্তরমুছুনঅাবার স্মৃতি নিয়ে টান দিলেন দাদা।
উত্তরমুছুন