ফেরারি কি সওয়ারি



একজন একলা বাবা > একটা অনেক দামী গাড়ি। একজন বুড়ো দাদু > একটা ব্যার্থ স্বপ্ন। একজন একলা ছেলে> একটা ইচ্ছাপূরণের গল্প।
হ্যাঁ এই নিয়েই খুব সোজা সাপটা কথায় বলা যায় ‘ফেরারি কি সওয়ারি’।

কায়ো। ছোট্ট একটা ছেলে যে মুম্বাইতে থাকে আর খুব ভালো ক্রিকেট খেলে। তার বাবা রুস্তম আর টি ও বিভাগের একজন হেড ক্লার্ক। তার দাদু ডেব্বু সারাদিন টিভি দেখে। কার্টুন…সিরিয়াল…খবর। একমাত্র ক্রিকেট বাদে সব কিছু। তাই নিয়ে কায়োর সাথে যে মাঝে মাঝেই ঝগড়া হয়না তেমনটা নয়। কিন্তু কায়ো তো খুব শান্ত আর ভালো ছেলে তাই দাদুর ওপরে চোটপাট করতে পারে না। কায়োর মা নেই। মায়ের গন্ধ তাই কায়ো বাবার কাছেই খুঁজে পায়। বাবাই তার জীবনের সব কিছু। হ্যাঁ তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা-রাগ-অভিমান-ঝগড়া সব কিছু তার বাবাকে ঘিরেই। বাবাকে নিয়ে কায়ো খুব-খুব হ্যাপি। কারণ তার বাবা যে কোনোদিন মিথ্যে কথা বলে না। কারোর সাথে ঝগড়া করেনা। কোনো অসকাজ করেনা। তাদের সেই পুরোনো স্কুটারে করে স্কুলে যাওয়ার পথে বাবা যদি ট্রাফিক রুল ব্রেক করে তাহলে নিজে এসেই ফাইন দিয়ে যায়। ট্রাফিক আঙ্কল, রাস্তার লোক, থানার দারোগা, কর্পোরেশানের কর্মচারী সবাই তাই বাবার বন্ধু। বাবার খুব কাছের মানুষ।

কায়ো ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখে। কায়ো শচীনের কথা ভাবে। কায়ো একদিন অনেক বড় মাঠে ক্রিকেট খেলবে এই আশা নিয়ে তার কোচরাও দিন গোনে…মনে মনে একটা আশা পোষণ করে। কিন্তু ক্রিকেট খেলার ঝক্কি তো কম নয়। তার ব্যাট, জুতো, বল…খেলার অন্যান্য সামগ্রীর যে অনেক অনেক দাম। তবুও কায়োর বাবা নিজের ভাঁড়ের পয়সা জমিয়ে, সংসারের টুকিটাকি খরচ কমিয়ে কায়োর জন্যে কত কি কেনে। কায়ো কিন্তু একটুও বায়না করে না। কায়ো কিচ্ছু চায় না বাবার কাছে। কায়ো জানে তার বাবার সাধ আর সাধ্যর মধ্যে যে আকাশ পাতাল তফাত। আর ঠিক এখানেই ফেরারি কি সাফারি আমার কাছে মনে হয় আধুনিক রূপকথা। চারপাশে কেউ খারাপ নয় কায়োর কাছে। এই ছবিতে তথাকথিত কেউ ভিলেন নেই। দুষ্টু লোকরা তাদের দুষ্টুমি করে বটে, তবে নিজেরাই তারা সাজা পায়।

গল্পের মোড় ঘোরে যখন কায়ো লর্ডসে একটা ওয়ার্কশপে যোগদানের সুযোগ পায়। কিন্তু তার জন্যে খরচ প্রায় দেড় লাখটাকা। কোচরা জানে কায়োর বাবা এই টাকা কোনোদিন যোগাড় করতে পারবে না এই অল্প সময়ের মধ্যে। কিন্তু সেটা কি করে মানবে কায়োর বাবা? সে তার পি এফ থেকে ধার করার চেষ্টা করে। নিজের গাড়ি বেচে দিতে চায়। কোথা থেকে শোনে ধার করার জন্যে নাকি মোবাইল ফোন লাগে, সে কেনে। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের দরজা ধাক্কায় “আমাকে দেড় লাখ টাকা ধার দেবেন প্লিজ! এই যে আমার ছেলে কায়ো…সে খুব ভালো ক্রিকেট খেলে…এই তো দেখুন না তার শিল্ড, কাপ, মেডেল, সার্টিফিকেট।” কেউ শোনে না তার কথা। কেউ ফিরেও তাকায় না।

এক একলা বাবা, একটা একলা শহরের মধ্যে সত্যি সত্যি একলা হয়ে যায় তার ছেলের ইচ্ছাপূরের স্বপ্ন নিয়ে।

দাদু মানতে পারে না তার ছেলের ক্রিকেট নিয়ে এই বাড়াবাড়ির আদিখ্যেতা। একদিন রাতে প্রচন্ড বকে ছেলেকে। আর কায়ো রাগতে থাকে। সব সময় খিটখিট করা দাদুকে কিছু বলতে গেলে, বাবার দিকে তাকিয়ে কায়ো কিছু বলতে পারে না। কিন্তু কোথাও ছোট্ট হৃদয়ে…ছোট্ট মনে সে লুকিয়ে রাখে অভিমানের চাপান উতোর। বাবা সেটা বুঝতে পারে। বাবা রাতে ঘুম পাড়ানোর ছলে বলে সেই অলীক গল্প। একটা ছেলে যে কায়োর মতোই খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। যে স্বপ্ন দেখতো ভারতের হয়ে খেলছে সে। সারাদিন সে কায়োর মতোই ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। তারপর একদিন যখন তার সত্যি ভারতের হয়ে খেলার সুযোগ এলো তখন তার খুব কাছের বন্ধু বদমাইশি করে তাকে আর খেলতে দিলো না। সব স্বপ্ন মরে গেলো তার। তারপর থেকে সে ক্রিকেট খেলা দেখে না। ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করে না। সে কষ্টে থাকে। দুঃখে। কে জানো সেই ছেলেটা? বাবা কেঁদে ফেলে গল্প বলতে বলতে। কায়ো জানতে পারে তার দাদুর আসল পরিচয়। নিমেষে চোখের সামনে বদলে যায় ছবিটা। দাদুকে এক রূপকথার হিরো বলে মনে হয় কায়োর।


কেউ একজন অফার দেয় বাবাকে, এক আন্ডার ওয়ার্ল্ডের দাদার ছেলের বিয়েতে ফেরারি গাড়ি চাই বরাতির জন্য। বর যাবে। আর সেই গাড়ি যদি সে ভাড়া এনে দিতে পারে তাহলে বাবা হাতে পাবে দেড় লাখ টাকা। কায়ো তাহলে লর্ডস যেতে পারবে। কিন্তু শহরে একজনের কাছেই সে গাড়িটা আছে। শচীন তেন্ডুলকার। কে আনতে যাবে তার কাছে গাড়ি? আর কেনোই বা শচীন দেবে?

 যে বাবা খুব সৎ পথে হাঁটতো। যে বাবা কোনোদিন মিথ্যে বলেনি। যে বাবা কায়োর কাছে এক আদর্শ পুরুষ… স্বপ্নের রূপকার সেই বাবা কী ভাবে আনতে পারে ফেরারি? আর কায়োই বা কী করে? আদৌ কি সে যেতে পারে লর্ডস? এইসব নিয়েই ঘুরতে থাকে গল্প…এই নিয়েই ফেরারি কি সওয়ারিরএক অনবদ্য পথ চলা।

আমাদের  দেশে যারা ছোটদের নিয়ে ভাবেন। ছোটোদের জন্যে লেখেন, ছোটদের জন্যে ছবি নির্মাণ করেন তাদের প্রায় একঘরে হয়ে থাকতে হয়। লেখকদের কপালে জোটে শিশু সাহি্ত্যিকের তকমা। বড় একটা কোথাও লেখার সুযোগ পান না তাঁরা। ছবি যাঁরা করতে চান তারা পান না প্রযোজক। ছোটোদের ছবির মার্কেট নেই বলে সবাই ঠোঁট ওল্টান। দেশে একটা চিলড্রেন্স ফিল্ম সোসাইটি আছে। মাঝে মাঝে তাদের ঢক্ক নিনাদ শোনা যায় তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই কম। এই বছরে যেমন তাঁরা বিজয়ীর হাসি হাসছেন। তাদের নির্মিত ছবি গাট্টু দেশে বিদেশের বাজারে বেশ সফলতা পেয়েছে। কিন্তু তা তো ব্যতিক্রমী উদাহরণ। যে ভারতে ছোটদের সংখ্যা ২০১১ সালের জন গনণা অনুসারে ১৫,৮৭,৮৯,২৮৭। সেখানে সারা বছরে দুটি- তিনটি ছোটদের ছবি কি যথেষ্ট? 


সত্যিই কি আমাদের দেশে এই ছবি গুলোর কোনো বাজার নেই? কেনো একটা গাট্টু, মাল্লী, মাকড়ি, ব্লু আমব্রেলা, তাহান, হ্যালোর মতো ছবির জন্যে আমাদের বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়? কেনো সরকারী কোনো পলিসিতে বিশ্বের প্রথম সারির সবচেয়ে বেশি সিনেমা উৎপাদন কারী দেশ হয়েও আমরা বছরে অন্তত দশটা ছবি ছোটদের জন্যে ধার্য করতে পারি না? এই প্রশ্নের জবাব হয়তো দেওয়ার মতো লোক নেই। আর নেই বলেই বড় অভিমানে থাকে বাড়ির পুঁচকেরা। তাদের তখন জাপানী সিরিয়াল ডোরেমান ভরসা। একটা অনুরোধ করি আপনাদের। গরমের ছুটি
শেষ। তবুও বাড়ির ছোট্ট সদস্যদের নিয়ে ছবিটা দেখে আসুন। মনে হয় সময়টা মন্দ কাটবে না। তিন প্রজন্মের গল্প শোনাতে বসে যে পটভূমির বিস্তার করেন বিধু বিনোদ চোপরার সৃষ্টিশীল লোকজনেরা, তা এক একথায় আমার কাছে আধুনিক রূপকথার মতো। 

পরিচালক-  রাজেশ মাপুশকর। প্রযোজক- বিধু বিনোদ চোপরা। কাহিনী- রাজেশ মাপুশকর, রাজকুমার হিরানি। সঙ্গীত- প্রিতম।  অভিনয়ে- সরমন যোশী, বুমান ইরানি, ঋতভিক শাহোর, পরেশ রাওয়াল, বিদ্যাবালান প্রমুখ।

 প্রকাশকাল-২০১২। মাই আনন্দবাজার ডট কম।
 
 

 

 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি