মালতী, নীতা আর আমি



দাদা এসে ঘুম ভাঙালো। বিকেল শেষের পড়ন্ত রোদটা সবে আমাদের বাড়ির উঁচু পাঁচিলটা ছেড়ে এবার কন্টিদের ছাদে মিলিয়ে যাবে। “এখোনও ঘুমোচ্ছিস ভাই? বিশালদের বাড়িতে টিভি এসেছে।” দাদার সাথে আমি ছুটি। কিন্তু ঢুকবো কী করে? সামনে যেন সিনেমা হলের মতো ভিড়। তবুও সবাইকে ঠেলে ঠুলে আমি আর দাদা ঢুকে পড়ি বিশালদের বাড়িতে কোনমতে। এককোণে জায়গাও হয়ে যায়। এই প্রথম পাড়ার লোকের সাথে আমি দেখি টিভি। উত্তেজনার পারদ আরোও চড়ে যখন একটা সিনেমা শুরু হয়। জানলা থেকে বাদুড় ঝোলা লোক, ঘরের মধ্যে ঠাসা ভিড়, রাস্তায় দাঁড়িয়ে গেছে পথ চলতি মানুষ। সবাই তাকিয়ে আছে চৌকো একটা কাঠের বাক্সের দিকে। আর সেই কাঠের বাক্সে একটা মেয়ে তার স্বামীকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে। স্বামী সেই নিদারুন ক্ষিদের দিনেও তার বউকে কিচ্ছুটি না দিয়ে খেয়ে নিচ্ছে সবটা। “কেমন হিংসুটে দেখ”। পাশ থেকে বলেছিলো জগাই। কিন্তু বউটা কিছু বলেনি। ঠায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। বাড়ি ফিরে লোকটা দেখেছে বউটা মরে গেছে গলায় দড়ি দিয়ে। পাশের বাগদি পাড়ার কমলের মা আঁতকে উঠেছে। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে বলেছে “অমন পুরুষের মুখে আগুন”। চোখ বন্ধ করলে বিকেলটা আমি দেখতে পাই। ‘বাইশে শ্রাবণের’ মাধবী, মালতী সেজে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার আলতা ফেরি করা বর প্রিয়নাথ আলতা দিয়ে লেখে যখন বাইশে শ্রাবণ, কোনও এক ছটফটে ছোটবেলার সন্ধ্যেতে মাথার মধ্যে ঢোকে না কিছু। কিন্তু কোথাও মনে থেকে যায় মালতীকে। তার মৃত্যুকে। কমলের মায়ের আঁতকে ওঠাকে। “অমন পুরুষের মুখে আগুন।”

অনেক রাতে বালীর বাসায় একসাথে পাত পেড়ে খায় বারোজন মানুষ। এপার- ওপার বাংলা মিলিয়ে বাবার কথায় “সংসার তরণী ভরপুর”।  খেতে বসে ঠাট্টা করে বলে, “একটু তুফান এলেই উলটে যায় বুঝি!” উল্টোয়নি কোনদিন আমাদের সংসারটা। দুহাতে আগলে রেখেছিলো আমার মা। হ্যাঁ এপারের মেয়ে। ওপার থেকে ছেড়ে আসা মানুষগুলোর সামনে একের পর এক পদ জুটতো না ঠিকই। কিন্তু রুটি আর ডাল শেষ হয়ে যেত চকিতে। লুকিয়ে দেখতাম রুটির ডেকচি খালি। জল খেয়ে শুয়ে পড়ছে আমার দিদার বড় আদরের, আর মৈত্র বাড়ির একমাত্র মেয়ে আমার মা। “মা, তুমি খেলে না?” মা হাসে। “কখন খাওয়া হয়ে গেছে”। এই রকম চলতো প্রায়ই। বাবার ছাত্ররা আসতো। হঠাৎই। কোনও আগাম খবর না দিয়ে। দূর দূরান্ত থেকে। মায়ের অন্নপূর্ণার ভাঁড়ার কোনদিন শেষ হয়নি। অথচ নিজের খাওয়ার জন্যে প্রায় বেশির ভাগ দিনই মজুত ছিলো জল। যতদিন না সেই আশির দশকের শুরুতে নতুন সরকার এসে শিক্ষকদের মাইনে বাড়ালো ততদিন মার খাওয়া চলতে থাকলো এমনি করেই। কোথাও মালতী আমার মা মিশে গেলো দুই প্রেক্ষিতের অন্তরালে। শুধু মালতীর প্রতিবাদটা থাকলো; আর আমার মা চেয়ে রইলো আমাদের বড় হবার প্রতীক্ষায়।


মালতীকে তো গলায় দড়ি দিতে হয়েছিলো আর নীতাকে?


“প্যান্ডেল রেডি টুকনু...এবার বালিতে চলচ্চিত্র উৎসব।” খুব তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে চলে গেলো ঝুলিদি। চিরুনী ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। ছোট ছোট ভাইরা ওর টাকাতেই পড়ে, বড় হয়ে ওঠে। ঝুলিদি আমাকে মাঝে মাঝে ডেকে খাওয়ায় তেঁতুলের আচার। আমের কাসুন্দি। ঝুলিদির বাবাও মণির মতো দেশের কথা বলে। রাতকানা বলে কোনও কাজও করতে পারেন না। ঝুলিদিকেই সামলাতে হয় সব কিছু। কাশীর দোকান থেকে ফিরতি পথে দেখি বড় বড় পোষ্টার পড়েছে সব রাস্তায়। একটা মেয়ে গলা উঁচু করে তাকিয়ে। চোখটা কি খুব জলজলে? কাঁদছে না তাকিয়ে আছে? বানান করে পড়ার চেষ্টা করি। অনেকক্ষণের চেষ্টায় উদ্ধার হয় একটা নাম। ‘মেঘে ঢাকা তারা’। উরিব্বাস। সেটা আবার কী? পাশের টিকিট কাউন্টারে হলদে, সবু্‌জ, লাল রঙের টিকিট। এর আগে দোল উৎসব শুনেছি, বসন্ত উৎসবে হেড স্যার গান গাইতেন। দুর্গোৎসবের রচনা লিখতে হতো। কিন্তু চলচ্চিত্র উৎসব? বাবা ফিরলেন টিকিট নিয়ে। আর অনেক রাতে ঘুম ধরা চোখে আমার কান্না পেলো। নীতার জন্যে নয়। ঝুলিদির জন্য। কিছুক্ষণ আগে ঝুলিদির ঝলসানো দেহটাকে পুলিশ ভ্যানে করে নিয়ে গেছে। আমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। আগাগোড়া মা আমার চোখ বন্ধ করে রেখেছে। এর অনেক পরে যাদবপুরের চলচ্চিত্র বিদ্যাবিভাগে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ঝুলিদিকে। বসন্তের এক পড়ন্ত দুপুরে আমার হাতে এসে পড়লো একটা লেখার টুকরো অংশ। প্রবন্ধকার, পরিচালক ঋত্ত্বিক বললেন, “ ট্রাম বাসের স্টপে সারাদিনের কর্মক্লান্ত, হাতে গুচ্ছেক কাগজপত্র ব্যাগ নিয়ে একটি মেয়ে, নিতান্তই সাধারণ একটি মেয়ে আমার বাড়ির কাছে দাঁড়ায়। তার চূর্ণকুন্তল মুখ এবং মাথার চারপাশ ঘিরে জ্যোর্তিমন্ডল তৈরী করেছে। কিছু বা ঘামে লেপটে গেছে। তার মুখের পাশে সূক্ষ্ম ব্যাথার দাগ গুলোতে ইতিহাস খুঁজে পাই।” ঋত্ত্বিক নীতাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। হারিয়ে দিয়েছিলেন অসীমতার মধ্যে। কারণ নীতাও তো মালতীর মতো কোনও প্রতিবাদ করেনি। সব কিছু মেনে নিয়েছিলো মাথা পেতে। চূড়ান্ত বিশ্বাস যে করেছিলো, অবিশ্বাসের ছুরি তার পিঠেই তো এসে বসবে। যতবার ফিরে যাই নীতার কাছে ততবার ঝুলিদি তার বাঁচার আকূতি, ভাইদের বড় করা নিয়ে হাজির হয় সামনে। অনেক না বলা কথা বলতে থাকে এক অন্য প্রেক্ষাপটে যার সূত্র আমার জীবনে জুগিয়ে যায় সাদা পর্দা।

শেষ করবো যাকে দিয়ে সে বড় মন কেমনের। বড় অসহায় মা। এক পুরুত স্বামীর সংসার গোছাতে যাকে তাড়াতে হয় প্রায় মৃতপ্রায় ননদ ইন্দির ঠাকরুনকে। যখনই ফিরে আসে তার স্বামী তখনই বাড়ি সারানোর, সংসারটা মেরামত করার কথা ওঠে। অপুকে একটা ভালো স্কুলে দেওয়ার আর দুর্গার একটা ভালো পাত্রের সাথে বিয়ের ব্যবস্থার স্বপ্ন হরিহর সর্বজয়াকে দেখিয়ে যায়। কিন্তু আমরা জানতে পারি সেই স্বপ্ন, সেই আশা কোনদিনও পূরণ হয় না। মেয়েকে বাঁচাতে পারে না সর্বজয়া। তার স্বামীর আর মেরামত করা হয় না সংসার। গ্রাম ছেড়ে...স্বামী হারিয়ে সে আবার যখন অপুকে নিয়ে ফিরে আসে, সেই অপুও আসতে আসতে দূরে সরে যায়। এক নির্বান্ধব পুরীতে অপুর প্রতীক্ষা করতে করতে সর্বজয়া মারা যান। দেশ পালানো, ঘর হারানো মানুষ গুলো সেই ছবি হাঁ করে দেখে। কাঁদে। শোকে উথাল পাতাল হয়। আর কোথাও যেন আমার জীবনে সাদা পর্দা মনে গেঁথে দেয় সেইসব নারীদের যাদের কাছে বারবার ফিরতে চাই। মন কেমনের রাতে। কিম্বা জীবনের হেরে যাওয়ার দিন গুলোতে। বিজয়ের উৎসবেও...। 

প্রকাশকাল-২০১২। মাই আনন্দবাজার ডট কম।
ছবি সৌজন্য- গুগুল ইমেজ। 


মন্তব্যসমূহ

  1. আমার টিভি দেখাও তো প্রায় একই রকম। তবে, তখনও, টিভি দেখার চেয়ে দর্শকরা কীভাবে দেখছে তা দেখতে ভালো লাগতো। সিনেমার কান্নার সময় দর্শকদের কাঁদা, হাসির সময় হাসা, প্রেমের সময় লজ্জা... অনবদ্য। আবার ফিরে গিয়েছিলাম ওই সময়টাই। দারুণ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি