আমার ইন্দুবালারা

আমাদের বালীর বাসায় একটা তোলা উনুন ছিল। একটা স্টোভ ছিল। সেই দুটোতে মিলিয়ে রান্নাঘর গমগম করতো। বড়মনি আর মা সেখানেই তাদের হাতের ম্যাজিক দেখাতো।

আমাদের বালীর বাসা। সামনে মা। আর পেছনে মনি। কিছু একটা জম্পেশ রান্না হচ্ছে।
মা বেড়ে উঠেছিল উত্তর চব্বিশ পরগণার আড়বেলিয়ায়। পুকুর, মাঠ খাল বিল সব কিছুর সাথে। তারপর থাকতে হয়েছিল দশ ফুট বাই দশ ফুটের বালীর বাসায়। সেখানেই আমরা চব্বিশ পরগণার খাওয়ার স্বাদ পেয়েছিলাম।

রাঙার বাড়িতে ছিল সিমেন্টের বানানো উনুন। রাঙা সেই উনুনে যখন ইলিশ মাছের ভাপা করতো সারা বাড়ি গন্ধে ম ম করতো।

রাঙা আমার বাবার কাকিমা। ঠাম্মাকে আমার মনে নেই। রাঙাকে অনেকদিন পেয়েছি আমরা। একটা বড় আশ্রয়স্থল ছিল রাঙা আমাদের ভাইবোনদের কাছে।
এমন কিছু রান্না কি ছিল যা রাঙা জানতো না? আমার মনে পড়ে না। নোনা ইলিশ রাঙার কাছেই প্রথম খাই।

আড়বেলিয়ায় মামার বাড়িতে আবার ছিল তিনটে উনুন। একটা খেজুর পাতায় জিরানো উনুন, কাঠের উনুন, কয়লার উনুন। আমার দিদা রান্না বুঝে সেইসব উনুন ব্যবহার করতেন। কোনটাতে পিঠে হবে। কোনটায় চুসির পায়েস। আর কোনটায় মাছের টক। যদিও তাঁর মুর্শিদাবাদের বাবার বাড়ির রান্নাঘর ছিল পেল্লাই সাইজের। মনে আছে যে পিঁড়িটায় আমাকে বসতে দেওয়া হয়েছিল সেটাতে আমি আর দাদা দুজনেই এঁটে যেতাম। সেই বাড়ির ছাদ থেকে দেখা যেত হাজারদুয়ারি। গঙ্গার স্রোত ছিল আমাদের রাসবাড়ির ঘাটের থেকেও বেশি।
মুর্শিদাবাদের নবাব বাড়ির পাশেই ছিল বাবার বাড়ি। সেখানকার গল্প কোনদিন দিদা করেনি। কেন করেনি জানি না। আমি যখন অনেক পরে গিয়েছিলাম তাজ্জব হয়েছিলাম। এই জাঁকজমক পূর্ণ বাড়ি ছেড়ে কোথাকার কোন অজ গাঁ আড়িবেলিয়াতে বিয়ে হয়ে যখন দিদা গেল কান্না পায়নি? কি জানি আপাতত আমি দিদার কোলে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করছি। আর দাদা চুপ করে পাশে বসে আছে।

মায়ের ঠাকুমা। আমার তাহলে কে? ঠাকুমাই। খেজুর পাতা্র আগুনে জিরান দেওয়া কুমড়ো ফুলের বড়া আমাকে আর কেউ খাওয়ায়নি। দাদা দেখছি বড্ড খুশি হয়েছে আমাকে কোলে নিয়ে।

মেজমনির বাড়ি বসিরহাটের শিবহাটিতে। রান্নাঘরটা ছিল ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায়। ইচ্ছামতীর মাছ ভাজা তার সাথে নারকেল দিয়ে মুগের ডাল মুখে লেগে আছে এখনও। বাড়িতে যে বড় তক্ষক সাপটা থাকতো দুপুরে ভাত খাওয়ার লোভে সেও ঘুরঘুর করতো উঠোনে।

মাঝের হাটে মায়ের পিসিমার বাড়ি। আমাদের মাঝের হাটের দিদা। কালো জিরে দিয়ে এমন যে চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল হয় তা যে না খাবে সে পস্তাবে।

বড়মার রান্নাঘর আমি অনেক বেশি বয়সে দেখেছি। বড়দা চাকরী পাওয়ার পর। খড়্গপুরের কোয়ার্টারে। নানা রকমের জেলি। গোকুল পিঠে। ক্ষীরের নাড়ু সব পোঁটলা করে নিয়ে এসেছিল কলাপোতা থেকে। বড়মাই ছিল আমার ওপার বাংলার চাবিটা। একটা বড় দরজা আমার সামনে খুলে দিয়েছিল সেই কবে কোন ছোট্ট বেলায়।
বড়মা বিশ্বাস করে পুকুরপাড়ে কাঁচামিঠে আমগাছটা এখনো আছে। বেঁচে আছে গোয়ালে হরিমতির বংশধরেরা। তারা এখনো দুধ দেয়। তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বলে। কিন্তু কে জ্বালায় তা জানে না।

আমার দিদিরা। বাঁদিক থেকে মুন্নাদি, রানীদি, আর টুকুদি। আমরা একটা বিশাল বটগাছের মতো সবাই এদিক ওদিক দিয়ে সবাইকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতাম।

কাকিমারা। বাঁদিক থেকে তিনজনেই নেই। কিন্তু রান্না গুলো রয়ে গেছে। এর ওর হাত ধরে।
দিদিরা বড্ড ভালোবেসে নানা রকমের রান্না করে এখনো খাওয়ায়। আমি পিছু পিছু রান্নাঘরে গিয়ে বসি। গল্প করি। টুকুদি গতবারেও আমাদের আচার খাইয়ে এইবছর কেমন লক ডাউনের আগে সবাইকে টাটা করে বৃষ্টিভেজা রাতে চলে গেল। একবারও পেছন ফিরে তাকালো না। টুকুদির মা নমিতা কাকিমার হাতের কচুবাটা যাঁরা খেয়েছেন তাঁরা ভুলতে পারেননি কোনদিন।

তখনও কাঁসারা থালায়, গ্লাসে, বাটিতে খাওয়া হতো। দাদা দিদিদের সাথে। কারও একটা জন্মদিন ছিল। যার সামনে প্রদীপ জ্বলছে তারই কী?

ভয়ঙ্কর ভাবেই যেটা অপছন্দ ছিল সেটা হল পড়াশুনো। ওদিকে ছন্দা সেন খবর পড়তে চলে এসেছেন পাড়ায়। আর মনি ভাজছে রান্নাঘরে পেঁয়াজকালি। পড়া কি সম্ভব? তাও দেখি মা ছাড়ে না।

 সারাদিন শ্যুটিং করে। মিটিং করে যখন ভবানীপুরের ওই এক চিলতে ম্যাজিক ফ্ল্যাটটায় পৌঁচেছি তখনই কেমন জয়াদি জেনে গেছে আমার ক্ষিদে পেয়েছে। আলু সেদ্ধ বসিয়েছে। তারপর সেটাকে ডিম দিয়ে কি সুন্দর একটা চটপটে রান্না করে এক বাটি দিয়েছে মুখের সামনে ধরে। ভাতের মধ্যে সবজী দিয়ে যে এতো ভালো রান্না হয় ভবানীপুরের ওই বাড়িটায় না গেলে আমি কি জানতে পারতাম? কক্ষোনো না। এরা সবাই আমার ইন্দুবালা। যে রান্নাঘর স্বপ্ন দেখায়। যে রান্নাঘর গেরস্থালির গল্প বলে।

বাঁদিক থেকে আমার মা, বড়মণি, আমার ঠাম্মা, কোলে দাদা, আর সবশেষে আমার হাঁদা। এমন একটা চপ বানাতো যে বয়সে খাবে সেই বয়সে রয়ে যাবে। আমি এদের চারপাশে ঘুরঘুর করি। ওত পাতি।
সেই রান্নাঘর ঘুরে বেড়াই। বিক্রম, দেবালয়, প্রদীপ্ত খুব ভালো রান্না করে। তার সাথে গল্পও। রান্না করতে করতে রাত হয়। গল্প বাড়ে। শ্রেয়ান মাঝে মাঝেই ফোন করে কল্লোলদা লেখা হলো? আমার ইন্দুবালা তখন কপোতাক্ষের ঘাটে মনিরুলের সাথে গামছা পেতে মাছ ধরে। আর সৈকত সক্কালবেলা উঠে সল্টলেক থেকে ফোন করেন “শোনো কল্লোল বাজার ঘুরে কিনে এনেছি তোমার চুইঝাল। শুধু তোমার ইন্দুবালা নয় আমিও রাঁধবো।” রান্না আমাদের মনের কথা বলে। পাত পেড়ে একসাথে হাপুশ হুপুশ করে খেতে খেতে গরম ভাতকে মনে হয় অমৃত। আর যাঁর রসনায় খাচ্ছি সামনের মানুষটি তখন ঈশ্বর। এদের সবাইকে নিয়ে আমার ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। ১২ জুলাই, শনিবার বিকেলে হোটেলের দরজা খুলবে। ভাগিরথী, ইচ্ছামতীর পাশে সেদিন বইবে কপোতাক্ষ।
  
বইয়ের প্রচ্ছদ। অলংকরণ করেছেন মেখলা ভট্টাচার্য। প্রকাশক-সুপ্রকাশ


মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি