গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর-২



নিছক গল্প নয়, এক মহাকাব্যিক আখ্যান


“অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলেন হে জনার্দন, যদি আপনার মতে কর্ম অপেক্ষা জ্ঞান শ্রেষ্ঠ হয়, তবে আমাকে এই হিংসাত্মক কর্মে (যুদ্ধে) কেন নিযুক্ত করিতেছেন? আপনি সন্দেহজনক রূপে প্রতীয়মান দ্বারা আমার মন যেন ভ্রান্ত করিতেছেন। এই উভয়ের একটি আমাকে নিশ্চয় করিয়া বলুন, যাহা দ্বারা আমি শ্রেয় লাভ করিতে পারি।

শ্রী ভগবান বলিলেন হে অনঘ, ইহলোকে জ্ঞানাধিকারিগণের জন্যে জ্ঞানযোগ এবং নিষ্কামকর্মিগণের জন্যে কর্মযোগ-এই দুই প্রকার নিষ্ঠার বিষয় সৃষ্টির প্রারম্ভে আমি বেদ মুখে বলিয়াছি।”

(শ্রীমদ্ভগবদ গীতা)

অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে দেখতে পাচ্ছেন করুক্ষেত্রের সেই নির্মম চক্রান্তকারী যুদ্ধ। যেখানে ভাই- ভাইকে, জ্ঞাতি-জ্ঞাতিকে, শিষ্য-গুরুকে, স্বজন-স্বজনকে হত্যা করছে। এই বধ্যভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়েছে বীরপরাক্রমশীল অর্জুনের রথ। কার দিকে নিক্ষেপ করবেন তিনি মারণ তীর? মুখোশের আড়ালে যে মুখ গুলোকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন সবাই তাঁর খুব প্রিয়, বড় কাছের, আপনার। কিভাবে কাটাবেন তিনি মায়া? কেন মারবেন প্রিয়দের? এই এতো লোকের রক্তবন্যায় আদৌ কি উচিত নিজের রাজ্যাভিষেক? এইবার শ্রীভগবান শুরু করলেন তাঁর অভয়বানী। মহাভারতের কথনের মাঝপথে হঠাতই সব কিছু থামিয়ে এসে পড়লো শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত এক বিস্তৃত আখ্যানের অন্য সূত্র “শ্রীমদ্ভগবদ গীতা”। তারপর অর্জুন অনায়াসেই হত্যা করতে পেরেছিলেন সকলকে। এমনকি পিতামহ ভীষ্ম, যাঁর কাছে ইচ্ছামৃত্যু বর ছিলো, তিনিও অর্জুনের দ্বারাই শরশয্যায় শায়িত হলেন। অর্জুনের স্বর্গারোহন হয়নি। কিন্তু কুরুক্ষেত্র প্রমান করেছিলো আমাদের জীবনে এমনটাই ঘটে।এটাই খুব ন্যাচারাল!  
হে পাঠক…রচনার শুরুতে মহাকাব্যিক আখ্যানের যে ছিন্ন সূত্র সম্বন্ধে আপনি জ্ঞাত হলেন তার যৌক্তিকতা আছে। আমাদের দীর্ঘ পরম্পরায়, আমাদের আখ্যানের গীত অংশে আমরা কি আমাদের ভাইয়ের রক্তে, আমদের জ্ঞাতির রক্তে, আমাদের হন্তক এবং হন্তিকার রক্তে রঞ্জিত নই? আমাদের মহাকাব্যিক রসের যে ধুয়ো মনে-প্রানে এক শান্তির সঞ্চার করে, তার পেছনে কি থাকে না এক অবমাননাকর, রক্তাক্ষয়ী যুদ্ধের সংগ্রাম? আমরা সেই রক্ত পিচ্ছিল পথে হাঁটি, স্নাত হই, করজোড়ে মহাবীর গাথা শুনি। আর মনে মনে সংশয় প্রকাশ করতে থাকি পাপ- পূন্যের আসল টীকা করণকে। ‘গ্যাংস অব ওয়া্সিপুরের’ দ্বিতীয় ভাগ জুড়ে যে হত্যার তান্ডব লীলা, যে রক্তের বন্যা, যে মুখ আর মুখোশের খেলা… তা যেন বারবার আমাদের মনে করায় সেই পরিচিত আখ্যানের ধুয়োকেই। প্রথম পর্বের যে ভৌগোলিক বিস্তৃতি আমরা ছবিটা জুড়ে দাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখি…সর্দার সিং এর পরাক্রমশীল যে মারণ জয়গাথা পরিচালক তাঁর আধুনিক চিত্রভাষায় আমাদের পরিচিত করান। দ্বিতীয় ভাগে এসে সংকুচিত হয়ে আসে পরিসর। বাড়ির উঠোন, গলি, ছোটো রাস্তার ধার, ঘিঞ্জি বাজারের চৌহদ্দি, ট্রাফিক সিগনালের জ্যাম আর ট্রেনের লাইনের মধ্যেই আটকে থাকে যুদ্ধ ক্ষেত্র। হত্যালীলার বধ্যভূমি। প্রথম ভাগে যে আপামর সূচিতায় এক বীরের গাথা অসাধারণ সিকোয়েন্সের চমতকারিত্বে গাঁথতে বসেন পরিচালক, সর্দার সিং যে পরাক্রম শীল বীর্যে মারা যান…। ধুয়ো গেয়ে ওঠে “বিহারকে লালা…”। দ্বিতীয় ভাগে তার জায়গা দখল করা তাঁরই ছেলে ফয়জল মারা যায় নিছকই শস্তা ভাবে। গাড়ির মধ্যে। নিজের ভাই ডেফিনেটের হাতে। যে ডেফিনেটের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো সর্দার সিং এর মৃত্যু, হ্যাঁ তাকে তার মা শিখিয়েছিলো নিজের বাবাকে ঘেন্না করার অনুশীলন। যদিও ফয়জলই তার দাদু, বাবা, আর দাদার খুনের বদলা নেয় রামাধীর সিংকে হত্যা করে। দীর্ঘ নৃশংস সেই দৃশ্যের অবতারণা, রক্তের সেই ফিনকি ধারা দেখে দর্শক প্রশ্ন করতেই পারেন তার ব্যবহারের কৌশলগত প্রকরণ নিয়ে। কিন্তু দয়া করে ভুলবেন না, এই রামাধীর সিং এর জন্যেই এই বিরাট আখ্যানের অবতারণা। এক-একটা মৃত্যুকে টপকে কাহিনীর এগিয়ে যাওয়া। ঠিক যে ভাবে রক্তের পায়ের ছাপ ফেলতে ফেলতে এগোয় ফয়জল। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের নব্বই শতাংশ পর্দার সময় অধিকার করে থাকা ফয়জল আক্ষেপ করে সে তার বাবার পথে হাঁটতে চায়নি কোনোদিন, সে চায়নি এত নিশংসতা, এতো রক্তক্ষরণ। সে চেয়েছিলো নেশায় বুঁদ হয়ে পড়ে থাকতে খোঁওয়াড়ে, জগত সংসার সম্বন্ধে উদাসীন থাকতে। সেই ফয়জল একদিন বিজয় রথ ওড়ায় ওয়াসিপুরে। কিন্তু তার মৃত্যুতে কোনো শোক গাথা পড়া হয় না। ধুয়ো এসে গান গায় না। বরং অনন্য সাধারণ চলচ্চিত্রীয় দক্ষতায় পরিচালক ফয়জলের মৃত্যুর পরে এই ছবির কথককে দেখান মুম্বাইয়ের এক বস্তিতে, ফয়জলের উত্তারাধিকারকে সঙ্গে নিয়ে। ব্যাক গ্রাউন্ডে ভেসে আসে ছবির মূল গান, “এক বগলমে চাঁন্দ হোগি…এক বগলমে রোটিয়া।” পরাধীন ভারতবর্ষে যে কাহিনীর বীজ প্রোথিত থাকে…স্বাধীনতা উত্তর ভারতে সেই বংশের ছেলে বেড়ে ওঠে মুম্বাইয়ের বস্তিতে। হ্যাঁ এবারও জানার অবকাশ থাকে না, শুধু অনুমান করে নিতে হয় উত্তারাধীকারীর ভবিষ্যত।
প্রথম পর্বের ছবির মধ্যে যে স্থিতিশীলতা ছিলো, চিত্রনাট্যের যে ধীর স্থির চলন ছিলো দ্বিতীয় পর্বে এসে সেই গতি যেন ছুটতে থাকে। পরতে পরতে পাল্টাতে থাকে ছবির মোড়…যদিও সেই মোড় আমাদের কাছে খুব স্থিরীকৃত, পূর্ব-নির্ধারিত। এক বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় ছবির আঙিনায় এক পরিচিত আখ্যানকে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে তাহলে কী প্রমান করতে চাইলেন অনুরাগ? তিনি কি ধরে রাখতে চাইলেন সময়ের ভাস্কর্যকে? যে সময় প্রতিনিয়ত অপসৃয়মান? যে সময় রেয়াত করে না ইতিহাসকে…মানুষকে…তার সভ্যতাকে? নিছক সময়ের ব্যবধান দেখানোর জন্যেই কি আসে পারপেন্ডিকুলার, ডেফিনেট এইসব চরিত্র? ছবিটা দেখতে দেখতে অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হই আমরা। অপরাধের সংজ্ঞা বদল হয়। তার চরিত্রও। যে সিনেমার রেফারেন্স দিয়ে দিয়ে একটু একটু গড়ে তুলছিলেন সময়কে পরিচালক। সেই সিনেমাও এসে একটা বড় প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় দর্শককে। রামাধীরের মুখে শুনি, “হিন্দুস্থানমে জব তক সিনেমা রহেগা…তব তক লোক চুতিয়া বন কর রহেঙ্গে।” চব্বিশটা ফ্রেমের মধ্যে যে চব্বিশবারের অন্ধকার…সেই অন্ধকার কতটা নিয়ে যায় আমাদের মিথ্যের দিকে? অনেকে আঙুল তুলেছেন এই ছবির ক্লিশে বিষয়ের প্রতি। অনেকে বলেছেন নতুন আর কী করলেন অনুরাগ? না, তিনি নতুন কিছু করেননি। তিনি শুধু সময়কে ধরে রেখেছেন এক আধুনিক চলচ্চিত্রীয় মহাকাব্যিক আখ্যানে দুই পর্বের ব্যবধানে। দেখিয়েছেন নির্মাণের এক নতুন প্রকৌশল। চিরাচরিত প্রকরণ গুলোকে যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি ভেঙেওছেন নিজের হাতে। প্রায় পাঁচ ঘন্টার এই দীর্ঘ যাত্রায় যাদের সাথে পরিচয় হলো, যারা সামনে এসে দাঁড়ালো, শোনালো তাদের গাথা…এরাই আমার দেশের এক অংশের নাগরিক। যেখানে সত্যি জমাট বেঁধে থাকে অন্ধকার। যেখানে সত্যিই একদিকে চাঁদ থাকে আর অন্যদিকে রুটি। যেখানে শোকটাকেও খুব সহজে বিক্রি করে দেওয়া যায়। পুত্র পিতার বুকে ছুড়ি মারে, ভাই-ভাইয়ের বুকে নিশান লাগায় গুলির। “মা ফলেসু কদাচনোর” এমন স্বার্থক উদাহরণ আর কোথায় পাবো? তাই এক অর্থে “গ্যাংস অব ওয়াসিপুর” আমার কাছে যেন এই সময়ের“ভারত এক খোঁজ”। 
পরিচালনা ঃ- অনুরাগ কাশ্যপ।

কাহিনী ও চিত্রনাট্য ঃ- অনুরাগ কাশ্যপ, সৈয়দ জিশান, অখিলেশ, সচীন লাডিয়া।

অভিনয়ে ঃ-  মনোজ বাজপেয়ী, জয়দীপ আহলোয়াট, রিচা চাড্ডা, নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি, জামিল খান, সৈয়দ জিশান কাদরি, আদিত্য কুমার, রিমা সেন প্রমুখ।
 
 ছবি সৌজন্য- গুগুল ইমেজ। ইউ টিউব


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি