মিঠে পিঠে পুলি


সর্ষে ক্ষেত যখন নীল দিগন্তে ফুলের আগুন ছড়িয়ে দিতো, সজনে গাছ গুলো যখন বরফ ঝরার নিস্তব্ধতায় সাদা ফুলের পাঁপড়ি ওড়াতো, মাধু বৈরাগী নিকানো উঠোনে এসে যখন লালনের গান গাইতো ঠিক তখনি গফুর চাচার আসার সময় হতো। ইচ্ছামতীর তীর ধরে সেই শীতের কুয়াশা ভরা সকালে গফুর চাচার সাইকেলের পেছনে বসানো থাকতো একটা বড় মাটির কলসি। নিজের কাঠের হাতা দিয়ে মেপে মেপে সেই কলসি থেকে গফুর চাচা গলানো সোনা রঙের মৌঝোলা গুড় তুলে দিতো দিদার পদ্মকাটা কাঁসার বাটিতে।আমি পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতাম কখন এক ফোঁটা দুফোঁটা পড়বে কলসি থেকে, বাটি থেকে, কাঠের হাতার নিখুঁত পরিমাপের নিক্তি থেকে। আর আমি সেই গুড় চেটে খাওয়ার আনন্দ পাবো। তখন নিজেকে বাড়ির জানলার কোনে গভীর সুড়ঙ্গে থাকা ডেঁও পিঁপড়েটার মতো মনে হতো। হা পিত্তশে অবশ্য করতে হতো না। শীতের ছুটিতে মামার বাড়িতে আসা সবচেয়ে ছোট নাতির জন্যে তখন এক এলাহি আয়োজন করে ফেলেছে দিদা। আর করবেই বা না কেনো? দিনটা যে পৌষ পার্বন। মিঠে পিঠে পুলি খাওয়ার দিন। তাই সময় নেই মুর্শিদাবাদের লালবাগের গঙ্গার ধারে থাকা পঞ্চাশ পেরোনো সেই মেয়ের। যে একদিন তার বাবার বিশাল কোঠা বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিলো আড়বেলিয়ার মতো অজ গাঁয়ে, পোর্টের এক কেরানীকে নিজের বর হিসেবে মেনে নিয়ে। চলে তো এসেছিলো দিদা। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো আমাকে আদর করে খাওয়ানোর জন্যে সরু চাকলি, চিতল পিঠে, পাটি সাপটা, রস বড়া, আনন্দ নাড়ু, আরো কত কত রকমের রান্নার সহজ সরল গেরস্থালি। 


ফুলে ভরা সজনে গাছের নীচেই দিদার ছোট্ট মাটির উনুন। অল্প অল্প করে দেওয়া শুকনো খেজুর আর নারকেল পাতার আগুনে লোহার চাটু তেতে উঠছে। আর সেই ঢিমে আঁচের উনু্নে দিদা আমার একের পর এক ভেজে চলেছে পাটি সাপটা। ঢেকিতে কোটা, জাঁতাতে ভাঙা নতুন চালের প্রলেপের ওপর ঘন হয়ে পড়ছে নাড়কেলের পুর। পিঠের ছ্যাঁক ছুঁক আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিদা বলে চলেছে উমনো ঝুমনোর গল্প। সতর্ক নজর থাকছে, এঁটো হাতে পিঠের কৌটো ধরছি কিনা সেই দিকেও। কারণ পুজোর পিঠে তুলে রাখার আগেই তো সব আমার পেটে যাচ্ছে। মোক্ষদা গরু দুইয়ে, গা মুছিয়ে, গোয়াল ঝাঁট দিয়ে বলে যাচ্ছে ওবেলা আমাকে তার বাড়ি নিয়ে যাবে। সে ‘আষ্টে পিঠে’ করেছে। এমা আষ্টে পিঠে জানো না? মৌঝোলা গুড়ে ডুবিয়ে খেতে হয়। দিদা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইছে “পেট ব্যাথা করছে নাতো টুকনু?” পেট ব্যাথা? ফুঃ…! সবে ক্লাস থ্রি থেকে ফোরে উঠেছি…আর কিছুদিন পরেই দাদার মতো গোঁফ হবে। তখন দেখো আমি নিজেই কেমন তড়বড় করে উঠে যাবো নারকেল গাছে পাঁচু কাকার মতো। একা একাই তোমায় নিয়ে যাবো আমাদের বালীতে। মাকেও আসতে হবে না। দাদাকেও না। বাবাকেও না। দিদা হেসে লুটোপুটি খায় আমার কথা শুনে। দিদার ইচ্ছা ছিলো থাকুক টুকনু আমার কাছে। আড়বেলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ুক। কিন্তু সেটা কী করে হয়? ওদিকে রিলিফ ক্যাম্পে ছানি কাটিয়ে এসে আমাকে যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে আর এক বুড়ি। আমার ঠাকুমা। 

আমার আর অপু হয়ে বেড়ে ওঠা হয়না সজনে গাছটার সাথে। উমনো ঝুমনো, পিঠে চুরি করা দুষ্টু রাখাল আর চিলেকোঠায় মাঝ রাতে ভয় দেখানো সেই মামদো ভূতটাকে টাটা করে আমাকেও চলে আসতে হয় বালীর বাসায়। পেছনে পড়ে থাকে গফুর চাচা, বসিরহাটের পাটালি, বেনেপাড়ার কাঁচা গোল্লা, দিদার ছলছল ভরা চোখ। “গরমের ছুটিতে আসবি তো টুকনু?” দিদার উত্তরে হ্যাঁ বলে এসেছিলাম। আর যেদিন অনেক ভোরে বাবা, মা, মামা, দাদার সাথে ছুটতে ছুটতে এলাম আড়বেলিয়া। সেদিনও দিদা পুকুরে চান করতে গিয়েছিলো। সেদিনও দিদা সজনে গাছের নীচে উনুন ধরিয়ে ছিলো। কিন্তু সেখান থেকে আর উঠতে পারেনি। আস্তে আস্তে বড় জামরুল গাছটার লম্বা ছায়ায়, গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ নিয়ে দিদা চুপটি করে চোখ বুজে শুয়ে পড়েছিলো নিকানো মাটির উঠোনে। মোক্ষদা দেখেছিলো কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিড় বিড় করে কিছু বলছে দিদা। মোক্ষদা শুনেছিলো দিদা নাকি আমাকে ডাকছিলো। উনুনের পাশে চুবড়ি ভরা ছিলো কুমড়ো ফুল। আমি জানতাম, সেদিন দিদা কুমড়ো ফুলের বড়া ভাজতো মিঠে পিঠের মতো করে। ওপরের আস্তরণে থাকতো ফুটকি ফুটকি পোস্তর প্রলেপ। দিদা ডেকেছিলো আমরা কেউই তখন সাড়া দিতে পারিনি। এখন যখন কান সজাগ করে পেতে রাখি, তখন আর কেউ ডাকে না। 


দিদার সাথে সাথে পিঠে পুলির পাট চুকলো পৌষ সংক্রান্তির দিনে। ঠাকুমা কোনোদিন পৌষ পার্বন উদযাপন করেনি। উদ্বাস্তু পরিবারে আবার বাস্তু পুজো কী? না, হয়নি কোনোদিন লক্ষ্মী পুজো। গভীর অভিমান ছিলো নবদ্বীপের মেয়ের। দেশ ছেড়ে আসার পরে আর একদিনও ঢোকেনি রান্না ঘরে। একটিবারের জন্যেও কোনো পছন্দের পদ রান্না করেনি। পিঠে পুলি তো দূরের কথা। বড় নির্লিপ্ত থেকেছে ঠাকুমা। মনের মধ্যে গুমড়ে ছিলো দাদুর শেষ কথা না রাখার কষ্ট, “ভিটে মাটি ছেড়ে যেও না কমলা!” কিন্তু সেতো অনেক দিন আগের কথা। তাই বলে কী পিঠে পুলি হতো না বাড়িতে? হতো। কিন্তু দিদার মতো নয়। আড়ম্বর ছিলো না। উতসব ছিলো না। শুধু হরিণঘাটার দুধের বোতল বাড়তি আস্তো একটা বা দুটো। আমি হা পিত্তেশ করে বসে থাকতাম তোলা উনুনের পাশে।পাটি সাপটার ছ্যাঁক-ছুঁক আওয়াজে মার দিকে তাকাতাম। মা হেসে বলতো “কী হচ্ছে না তো দিদার মতো?” না সত্যিই হয়নি দিদার মতো কোনোদিন। হতে পারে না। কেউ চলে গেলে অন্য কেউ তার জায়গা ভরাট করতে পারে না যে। তবু সময় চলে তার নিজের খেয়ালে। সজনে গাছটা এখোনো ফুল ফোটায়। টুপ টুপ করে ঝরে পড়ে ভাঙা উনুন, মনুষ্যহীন মামার বাড়ির উঠোনে। আর দিদাহীন সকাল বিকেল গুলোয় মিষ্টির দোকানের র‍্যাকে ভর্তি হতে থাকে পাটি সাপটা, মিঠে পিঠে পুলির নানান চমক। কিন্তু সেখানে নেই উমনো ঝুমনো,  নেই সেই দুষ্টু রাখালটা। নেই দিদার মন কেমন করা হাসি।

ছবি গুগুল ইমেজের সৌজন্যে
মাই আনন্দবাজার ডট কমে প্রকাশিত। ২০১২। 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি