নিঃসঙ্গতার হাজার বছর

ডাক এসেছিল অনেক আগেই। ডাক এসেছিল মনে। চারপাশের গন্ডির চেনা শেকলটা ভাঙতে চাইছিল কেউ। আর চুপি চুপি কানে কানে এসে শীত শেষের ঠান্ডা বাতাস বলছিল, বেরিয়ে পড় টুকনু এবার। অনেক দিন, অনেক কাল, একই স্মৃতির মেখলা গায়ে দিয়ে বসে আছো। এবার তোমার যাত্রা শুরু। হাওড়ার স্টেশনের ভিড়ে ঠাসা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে আমি আস্তে আস্তে এগিয়ে ছিলাম একা। নিঃসঙ্গতার উষ্ণতা দুহাত পুইয়ে নিতে, আদরের রোদ গায়ে মাখতে হাজার বছরের প্রাচীন এক জনপদে। ভোরের কুয়াশা আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সম্ভাষণ জানালো। "হাজার বছরের প্রাচীন জনপদে তোমাকে অভিনন্দন টুকনু"। বেনারস তার অবিকল নিঃসঙ্গতা নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
সূর্যোদয়ের রক্তিম আভা আমাকে কোনো নতুন চমক দেয় না। দিতে পারে না। নদীর যে বহমানতা, তার গতি আমাকে ব্রাহ্ম মুহূর্তে শুধু মনে করিয়ে দেয় বারবার একটা ঘরের কথা। একটা বাঁচার গল্পের কথা। একটুকরো রুটির কথা। আর বেশ কিছু মানুষের স্বপ্নের জালবোনার কথা। সে গুলো আমি গঙ্গার ঘাটের কাছে রাখি। দূর থেকে কে যেন আমাকে ডাকে। পথের পাঁচালীর ছিঁড়ে যাওয়া মলাটের ভাঁজ থেকে বেরিয়ে আসেন কি হরিহর? আমার কপালে চন্দন আর কুমকুমের তিলক এঁকে দিয়ে কি বলেন জয়যাত্রায় যাও গো? চোখ তুলে দেখি বিহারের পবন কুমারকে। ছাতার তলায় অবিকল বসে অন্য কোনো এক পথের পাঁচালীর লেখকের জন্যে অপেক্ষা করছেন। কিম্বা শোনাচ্ছেন এই বছরের ব্যবসা না হওয়ার মন্দার কথা। পাশে পড়ে থাকছে রামচরিত মানস।
এটাই আমার প্রথম বেনারস ভ্রমণ নয়। এর আগেও আমি বেনারস এসেছি। তবে কাজে। শ্যুটিং এর বড় ইউনিট ছিল। কাজের টেনশান ছিল। ঘোরাটা কোথাও ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিল সেই রুটিন থেকে। কিন্তু এবার সেটা হবে না। কাঠিয়া বাবার আশ্রমের আশ্রমিক চিনিয়ে দিয়েছেন গঙ্গার পথ। ভোরের স্নান যাত্রী এগিয়ে দিয়েছেন সবে নরম রোদে ভরে যাওয়া গলি। দাক্ষিনাত্য থেকে আসা পুন্যার্থীদের ভিড়ে ভোরের নির্বাহতা অনেকটা সজাগ জাগ্রত শিবের ধ্যানে পরিণত। ভোরের নরম আলো গায়ে মেখে তাই নাগা সন্ন্যাসী শুকিয়ে নিচ্ছেন সবে গায়ে মাখা ছাইয়ের প্রলেপকে। আর তৃষ্ণাতুর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নিঃসঙ্গতার অলি গলিকে।
তুমি বলবে খামোকা আমি কেন বারবার টেনে নিয়ে আসছি নিঃসঙ্গতার অলি-গলিকে? আমি একা এসেছি বলে? কিন্তু সত্যি কি আমি একা? না, কখোনোই নয়। আমার সাথে এসেছেন আমার দিদি। এক ট্রেন ভর্তি লোক। কাঠিয়া বাবা আশ্রমের সন্ন্যাসীরা। আর এসেছে একটা জেদ। বেরিয়ে পড়বার। বাঁধন হারাবার। পিছুটানকে লোপাট করার অহর্নিশা। এই এত কিছুর মধ্যেও আমের আগের অস্তিত্ত্ব আর এখনকার মধ্যে অনেক ফারাক তৈরী করে বেনারস। কোথাও যেন মনে হয় পৃথিবীর যে সব প্রাচীন সভ্যতা আছে তাদের মধ্যে কোথাও যেন বেনারস প্রাচীন থেকে আরো প্রাচীনতর। জ্যান্ত একটা শহর। যে শহর অন্যান্য জনপদের থেকে হাজার বছরের পুরোনো। যে জনপদ নিঃসীম এক নিঃসঙ্গতার রূপকার। তার দেহে, উপস্থিতিতে, চলমান প্রবাহমানতায়।
এই চলন কি শুধু কি তার আধ্যাত্মিক চলমানতায়? নাকি মনের গভীর গোপন কোনের তামশাবৃত অন্ধকারের উন্মীলনের দূরাগত আকাঙ্খা? কোনটা? কি প্রকাশ হয়েছে-আর কি মুহূর্তে প্রকাশ হবে তার কিংবদন্তি মূঢ়তায় আচ্ছন্ন? কোনটা আমির আমি তার বিচক্ষণ জনিত তার্কিক পক্রিয়ায় না গিয়ে, নিজের ভাবার অবকাশের গন্ডি টপকিয়ে যে স্পেক্টাকলের বর্ণমালায় নিমজ্জিত হই সেখানে বেনারস তার ভুবন জোড়ানো অস্তিত্ত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দৃষ্টি আর সৃষ্টির বর্ণমালার তীর, তিরন্দা্জ, অভ্রভেদি এক প্রাচীন চিত্রের আকারে জড়িয়ে লেপটিয়ে থাকে পথে ঘাটে। গঙ্গার ঘাটের দেওয়ালে।
আর যে স্তব, মুদ্রা, বরাভয় আমাদের ভীতু জীবনের গন্ডি টপকিয়ে ঈশ্বর মুখরতা কোরে তোলে। আমাদের বিশ্বাস করতে শেখায় পুরাকালের কথা, তারা বর্ণমালার আধিক্যে জড়িয়ে থাকে।
প্রত্যেকটা ঘাট গল্প বলে। প্রত্যেকটা ঘাট আসন সাজিয়ে আপ্যায়ণ করে। প্রত্যেকটা ঘাট ফিসফিসিয়ে সেই অভিশাপের কথা বলে যে পাপে অহল্যা পাথর। যে শাপে রাজা হরিশচন্দ্র আজ ডোম। নিজের পুত্রের চিতা নিজেকেই সাজাতে হচ্ছে। আমি ঘুরি। রাতের পর রাত। আমি ঘুরি সন্ধ্যা আরতি সাজিয়ে। আর সেই ভীষণ ভিড়ে বড় একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি বেনারসকে।
আগুনের তাপ গায়ে লাগে। চিতার না প্রদীপের? শিব চতুর্দশীর লগ্ন তখন সমাগত। গঙ্গার ঘাটে তখন দীপাবলী। আমি পুড়ছি...ব্রহ্মান্ড পুড়ছে...কিন্তু নিতান্তই স্নিগ্ধতায়।
তবে এই প্রতীক্ষা কিসের? কোন সভ্যতার দ্বার উণ্মীলনের? নাকি নিতান্ত আমার কল্পনা। আমারই প্রগলভতা আমাকে ছাপিয়ে যায়। তখন চোখের সামনে যে দ্বার থাকে খোলা...সে অপেক্ষা করে থাকে নিঃসীম অন্ধকার। 
এই অন্ধকার আমাকে পরের দিনের সূর্য দেখার সংকল্প করায়। নিঃসঙ্গ এক জনপদে সবাইকে চমকে না দিয়ে, আদি কবির বিস্ময়কে যেন বারবার চিত্রায়িত করে স্পেক্টাকল। আর এই সবের মাঝে নিঃসঙ্গতার হাজার বছরে দাঁড়িয়ে থাকে প্রাচীন জনপদ বেনারস।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি