এসেছো প্রেম এসেছো আজ...



“আমি বাঁচতে পারতাম। আমি থেকে যেতে পারতাম, যদি একবার  সে আমাকে থেকে যেতে বলতো...। কিন্তু না...সে আমাকে কিছু বলেনি...। আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে থেমে গিয়েছিল তার হাত...। আমি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম আমার বেনারসের পুরোনো গলি...। গঙ্গার ঘাট...মন্দিরের সিঁড়ি...বিশ্বনাথের আরতি...। ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম একটা পাগলা বন্ধু...। যে ছোট থেকে আমার সাথে ছায়ার মতো জড়িয়ে ছিলো। ছেড়ে যাচ্ছিলাম বিন্দিয়াকে। যে মেয়েটা আমাকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। ছেড়ে যাচ্ছিলাম জোইয়াকে যাকে প্রাণের চেয়ে ভালোবেসেছিলাম...যে একবার আমাকে থেকে যেতে বললে আমি থেকে যেতাম...। কিন্তু না...সে আমাকে কিছু বলেনি...। আমার থাকা হয়নি...অনেক কিছু স্মৃতি নিয়ে মরতে হলো আমাকে।”

প্রথম পুরুষের আখ্যানে এক মরদেহের জবানবন্দিতে শেষ হয় ‘রাঁঝনা’(Raanjhanna)। হাসপাতালের আই সি ইউ এর শয্যায় তখন কুন্দন রূপী ধানুশ। আর মাথার কাছে চুপ করে বসে থাকা জোইয়া, সোনম কাপূর। চকিতে ক্যমেরা ঘুরে আসছে সবার মুখ। বেনারসের ঘাট। শিবের মন্দির। মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মরে যওয়া কুন্দনের ট্র্যাজিক বীরগাথা। একশো চল্লিশ মিনিট ছবির শেষে মাল্টিপ্লেক্সে এক সূচীভেদ্য নৈঃশব্দতা। ক্রেডিট টাইটেলে বাজতে থাকা রহমানের সুর...আর অনেক রাতে ট্রেনের বৃষ্টিভেজা জানলায় মাথা রেখে বাড়ি ফেরা। 

এই ছবির আখ্যান মূলত ধানুশের জবানবন্দী। হ্যাঁ এক মরতে থাকা...মারা যেতে থাকা মানুষের ভালোবাসার গল্প। কত যুগ থেকেই, প্রায় একশো বছর হয়ে গেলো আমরা একই ভালোবাসার গল্প শুনে আসছি চলচিত্রের পর্দায়। একই গল্প নিয়ে আলোচনা করছি। চিত্রনাট্য লিখছি। সংলাপ বসাচ্ছি চরিত্রদের মুখে। ভালোবাসার নেগেটিভ পরিণাম দেখে চোখের জলে নাকের জলে এক হয়ে কতবার বেরিয়ে এসেছি। হিন্দু মুসলমান প্রেমের গল্পের নজির নেহাতই কম নয় হিন্দি ছবির দীর্ঘ তালিকায়। নব্বইয়ের প্রথম দিকে বাবরি মসজিদ ভাঙার পটভূমিকায় মণিরত্নমের ‘বোম্বে’কে ভুলবো কী করে? মূলধারায় গল্প বলতে বসে, জনপ্রিয় আঙ্গিকে যেভাবে আঙুল তুলে প্রশ্ন করেছিলেন সেদিন মণিরত্নম অনেকেই তা সেই সময়ে পারেননি। 


সেই প্রথম দেখেছিলাম তিনদিন টানা কার্ফুর পর পাড়ার মুদির দোকানে জিনিস কেনার লম্বা লাইন। অনেক রাতে সাইরেন বাজিয়ে মিলিটারিদের টহল। নিজের খেলার মাঠে খেলতে না পারার অধিকারহীনতা। কিন্তু সেটা অন্যপ্রসঙ্গ। অন্যলেখার খড়কুটো। যেটা বলতে চাইছিলাম, হিন্দি ছবির জনপ্রিয় আঙিনায় আমরা হিন্দু মুসলিম প্রেম এবং বিবাহ দেখেছি। কংগ্রেস আমলের জাতীয় ঐক্য “মিলে সুর মেরা তুমাহারা...” আমা্দের সেই সময়ের দূরদর্শনের মাছের চোখ হয়ে উদ্ভাসিত ছিলো। আর যতবার অকাল বোধনের ঢাক বেজে উঠেছে ততবার প্রপাগান্ডার আসল চেহারাটা বেরিয়ে এসেছে। ভাঙা হয়েছে মসজিদ। পোড়ানো হয়েছে মানুষকে। বে্ধেছে দাঙ্গা। আর এইসবের মধ্যে সেই রক্তক্ষরিত সময়ে, অসাধরণ মন কেমনে জেগে উঠছে ‘নসীম’। বড় মন খারাপে এক আলো আঁধারির ছবি নির্মাণ করতে বসছেন অনেক দিন পরে সইয়দ আখতার মির্জা। শহরে কার্ফু। মুসলমান পাড়ায় টহল দিচ্ছে আধা সামরিক বাহিনী। আর এক বৃদ্ধ দাদু তার নাতনী নাসীমকে শোনাচ্ছেন দেশ স্বাধীন হবার ইতিহাস। নসীম মানে তো ভোরের সেই নতুন দমকা হাওয়া। সেই হাওয়ায় কী এই জাতপাতের রক্তাক্ত দাঙ্গা একদিন উড়ে যাবে অনেক দূরে? নসীমের প্রশ্নের উত্তরটা দেওয়া হয়না দাদুর। কোনো একভোরে...বাবরি মসজিদ ভাঙার সন্ধিক্ষণে মারা যান তিনি। একযুগের অবসান ঘটে। আঁধার নেমে আসে নাসীমের মুখে। সইয়দ আখতারের ক্যামেরার যে স্থির চলন, তাতে একটা মুসলিম পরিবারের দিন থেকে রাত নামে। আবার দিন হয়। এক ক্ষয়িষ্ণু সমাজের আলোছায়ায় ছবি আঁকেন মির্জা সাহেব। 
কিন্তু মণিরত্নম সেই পথে হাঁটেন না। তার শেখর নারায়ণ পিল্লাই (অরবিন্দ স্বামী) আর শৈল বানু (মনীষা কৈরালা) জনপ্রিয় ছবির আঙ্গিকে দাপিয়ে বেড়ায় সাদা পর্দা। হিন্দু মুসলিমের প্রেম ভেদ করে, তাদের ছোট সুখী সংসারের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে দুর্যোগের কালো মেঘ নয়, গেরুয়া রঙের কর সেবকরা। গ্রামের জাতপাতের দোহাই এবার শহরের রাস্তায়। কোথায় যাবে শৈলবানু? কোথায় যাবে তামিল ব্রাহ্মণ পুত্র নারায়ণ পিল্লাই? বোম্বের রক্তাক্ষয়ী দাঙ্গার এক কালোরাতের শেষেও বেঁচে যায় শৈলবানুর পরিবার। মণিরত্নম বাঁচিয়ে দেন শৈলবানুর দুই যমজ ছেলে, স্বামী, আর তাদের সংসারকে। রাজীব মেননের ক্যামেরা নতুন ভোরের ইলিউশান তৈরী করে। আমরা বিভোর হই। আমরা কোথাও মিলে সুর মেরা তুমাহারার প্রতিধ্বনি পাই। 

কিন্তু ‘রাঁঝনা'তে (Raanjhanna) প্রেমের যে সংকেত আসে, অবলোকনের যে তথ্য এবং সংবাদ প্রেরণ করা হয় সেখানে কোথাও হিন্দু-মুসলিম তথাকথিত অসম বিয়ে, ওই রকম গোঁড়া জাতপাতের অলিতে গলিতে ধুন্ধুমার কান্ড ঘটায় না। বরং এক মিষ্টি প্রেমের গল্প বলতে বসে গল্পকার, চিত্রনাট্যকার হিমাংশু শর্মা এঁকে চলেন এমন এক ত্রিকৌনিক প্রেক্ষিতকে যেখানে বেনারসের অলিতে, গলিতে বংশ মর্যাদায় তামিল ব্রাহ্মণের পূজারী ছেলেকে প্রত্যাখ্যাত করে এক মুসলিম নারী। এক মুসলিম নারীর জন্য প্রাণ দেয় দুই হিন্দু প্রেমিক। এক দিকে অভয় দেওল অন্যদিকে ধানুশ। একজন জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল ঝান্ডা হাতে ধরা তরুণ তুর্কি নেতা। অন্যদিকে বেনারসের কবেকার সেই অলিতে, গলিতে বেড়ে ওঠা কুন্দন। মাঝে জোইয়া। মাঝে প্লাকার্ডে ফেস্টুনে হঠাতই এসে পড়া বেনারস সম্প্রসারণের স্লোগান। কিম্বা জে এন ইউ এর ক্যাম্পাসে চে’র মুখ। 
কাশির গলিতে শিব সাজা এক ছেলে, যার বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরের তামিল ব্রাহ্মণ পূজারী তাকে মরতে হয় এক মেয়ের ভালোবাসায়। তাকে মরতে হয় স্লোগান দিতে গিয়ে। তার কাছে রাষ্ট্র তখন বড় নয়...তার কাছে পার্টি কোনো আদর্শ নয়...সে লড়ছে তার অন্তরের বিবেকের তাড়নায়। সে লড়ছে তার জোইয়ার প্রেমকে শ্রদ্ধা জানাতে। যে প্রেম সে নিজে হাতে কবর দিয়ে এসেছিলো তার সবচেয়ে ভালোবাসার কাছের মানুষটার বিয়ের দিনে। জোইয়া তাকে চায়নি। জোইয়া বলেছিলো ছোটবেলার ভালোবাসাটা ভুলে গেছে সে...জোইয়া বলেছিলো ঘেন্না করে তাকে...তার মতন এক গ্যাস সিলি্নডার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, হাতে হাতে দোকানের লোকের কাছে কাজ করা কুন্দনকে সে ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসা যায়না। কাজেই জোইয়ার শিক্ষিত রাজনীতি করা প্রেমিক যেদিন মারা যায়, ঘেন্নায় রাগে থুথু ছিটিয়ে দেয় কুন্দনের গায়ে জোইয়া। কু্ন্দন বুঝতে পারে কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে বিলকুল। প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে তাকেও মরতে হয়। একের পর এক গান এসে পটভূমি দখল করে। স্ট্রিট ড্রামা ছিঁড়ে নিয়ে যায় কথনের কিছু অংশ। ভালোবাসাটা এক অমিমাংশিত পটভূমিতে ছেড়ে রেখে চলে যান পরিচালক আনন্দলাল রাই। কুন্দনের মৃত্যু হয়। কিন্তু ভালোবাসার?

একই গল্পের ভেতরে, একই দৃশ্যায়ণের রাজত্ত্বে যে চিহ্ন, সংকেত গুলো পাঠাতে শুরু করেছে সাদা পর্দা সেগুলো কি পড়তে পারছি আমি? কি জানি? ‘হিংসা ও পরিচিতি’ আমাকে কোন চিহ্নায়ণের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ভাবতে গিয়ে দেখি অনেক রাত হয়েছে। বাড়ি ফিরছি একা একা, এক আকাশ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে। কোথাও যেন,  কোন এক বাড়ি থেকে রেডিওর তরঙ্গে ভেসে আসছে...কোনো এক গানের কলি... “বিরস দিন বিরল কাজ, প্রবল বিদ্রোহে. এসেছ প্রেম, এসেছ আজ কী মহা সমারোহে...”।

ফোন বেজে ওঠে। মাকে বলি... বাড়ি ফিরছি মা। তুমি শুয়ে পড়।

মন্তব্যসমূহ

  1. অস্থির সময় আমাদের দেশের যেন একটা নির্দিষ্ট রুটিন , তার মাঝে এমন অনেক স্মৃতি অনেক প্রেম অনেক কথা লুকিয়ে থাকে কয়েকজন মানুষ কেবল পেরেছেন সেটা কে ধরতে , মনিরত্নম তার একজন।

    ভালো লাগাল রনঞ্ঝন তে আবার এমন সব ছাপ আছে শুনে।

    উত্তরমুছুন
  2. ছবিটা দেখতে দেখতে ৩ বার নিজের বান্ধবি কে ফোন করি শেষে ফোনের ওপার থেকে বলে ওঠে " কি বেপার নিশ্চয় সিনেমাটা তে ছেলে মেয়েরটার মিলন হছে না তাই এত বার ফোনে করছ? " প্রেমের ছবি আমি একদম পছন্দ করি না কারন কখনো শেষে মেয়ের বাবা হাত ছেরে দেয়ে না আর সে দৌরে ট্রেন এ উঠে চলে যায়ে না বা "আমি তোমাকে ভালবাসি" বললে সেই মেয়ে তোমার সাথে ফুচকা খেতে রাজি হয়ে যাবে না সারা জীবন এর জন্য... তাই আমি প্রেমের ছবি দেখি না।।কিন্তু এই ছবি অন্য জিনিস দেখাল হ্যাঁ ১৬ বার থাপ্পর খেতে হয়ে নিজের থেকে সুন্দরী মেয়ে সাথে ময়েদান এ হাত ধরে হাটার জন্য রাজি করার জন্য। হ্যাঁ রাগ হবে যখন ত্রিকোণ প্রেম এ পরতে হয়ে এবং রিয়ালিটি শো এর মত ভোটে হেরে বিদায় নিতে হয়ে । মদ্দা কথা আরও অনেক কিছুর পর শেষ যেটা ভেবেছিলে যেটা স্বপ্ন দেখেছিলে সেটা হয়ে না শুধু পরে থাকে তোমার ছেলেবেলা পরে থাকে তোমার সুখের সৃতি ।। এখানেও তাই দেখাল এই তো দেখতে চেয়েছিলাম ।। অনেক তহ "জহুরি" রা প্রেমের ছবি দেখাল, এতাও তো প্রেম এমন প্রেমই হছে পাড়ার পলটু ,সঞ্জু দের সাথে...তা হলে...।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি