মাই নেম ইজ খান

মাই নেম ইজ খান 
 
An ordinary man…
An extraordinary journey…
For love...

পোষ্টারটা...লাইনগুলো অনেকদিন আগে থেকেই চোখে পড়েছিলো...তারও আগে থেকে জল ঘোলা চলছিলো বিস্তর...ছবির পোষ্টার ছেঁড়া হচ্ছিলো...রক্ত চক্ষুর বন্যা বইছিলো কাগজে...টিভি চ্যানেলে...ফিল্মি মুখোরোচক নানান খবরে স্লট ভরছিলো বেশ। অবশেষে ছবিটা মুক্তি পেলো...দর্শকও নানান হুমকির পাশ কাটিয়ে...বাঁদর সেনাদের লাফালাফিকে পাত্তা না দিয়ে ছবি দেখতে গেলেন। প্রথম কয়েকদিনের বেজায় ভিড়ের ধাক্কা সামলে হঠাতই ফেব্রুয়ারীর এক পড়ন্ত বিকেলে আমিও টুক করে  ঢুকে পড়লাম হলে। দেখলাম  মাই নেম ইজ খান
 
চকিতে এয়ারপোর্টের চেকিং লাউঞ্জে আবিষ্কার করলাম সারাক্ষণ নানা রকমের অস্বস্তিতে ভোগা রিজওয়ানকে...সারাক্ষণ মুখে যে বিড়বিড় করে চলেছে কোরানের সুর...। ক্ষণিকের মধ্যে যাত্রীদের কারো ভয়ার্ত ইশারায় সবার মনে হতে থাকে সে টেররিস্ট...
পটভূমি যেহেতু আমেরিকা...তাই তাকে নানা রকম প্রশ্ন আর উত্তরের মধ্যে আদ্যোপান্ত তল্লাশী চালানো হয়...আমরা জানতে পারি রিজওয়ান আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চলেছে...
আমরা জানতে পারি তার কাছে তেমন পয়সা আর নেই যাতে সে পরের ফ্লাইট ধরতে পারে...
রিজওয়ান বাসের প্রতীক্ষায়...রিজওয়ান এবার তার অতীতে...তার ছোট্ট নোট খাতায় প্রেসিডেন্টকে লিখছে তার চিঠি...কেন সে দেখা করতে চাইছে তার সঙ্গে...
এরপর আমরা ক্রমশ প্রবেশ করতে থাকি রিজওয়ানের অন্দরে...তার আসর্পেগারস সিনড্রোমে...তার অতীতচারিতায়...তার বর্তমানে।
প্রায় তিন ঘন্টার ছবিতে আমরা দেখি মুম্বাইয়ের এক ঘিঞ্জি এলাকাতে থাকা...দাঙ্গা দীর্ণ এলাকার বাসিন্দা রিজওয়ান ঠিক কিভাবে...কেন...কিসের তাগিদে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করবে।

 
যে পরিব্রাজনের চিহ্ন তার শরীরে...তাকে ফলো করতে থাকে করণ জোহরের ক্যামেরা...তার আখ্যান। পরিচালক তাঁর অফিসিয়াল সাইটে লেখেন...
“The journey to make this film has been heavily laden with self discovery and dipper understanding and various manifestations of love, loss, strife, fear ignorance and social consciousness. Stretching beyond a form and process of story telling that I have been comfortable with earlier this film challenged me to understand a multitude perspective as I tried to convey all of various opinions, facts, and propaganda that comes with the global issue of discrimination and intolerance towards a race of people completely unassociated by the evils of terrorism ”

 
আখ্যানের নানান দৃষ্টি ভঙ্গীর যে দাবী পরিচালক তার জবানীতে করেন তার সার্থকতা কতটুকু ছবিতে প্রকাশ পায় তার বিচার দর্শকরা করবেন। কিন্তু চরিত্রের নিপুণ বুনটে এক জনপ্রিয় আঙ্গিকে গল্প বলতে বসে পরিচালক রিজওয়ানকে প্রায় মানুষ থেকে দেবতায় উত্তরণ করেন। সে এমন এক জাতিকে প্রতিনিধিতত্ত্ব করে যারা পথে ঘাটে অপমানিত...সংশয়াতিত...নির্যাতিত...নানাভাবে...নানা কারণে...
কাজেই রিজওয়ানের এই পরিব্রাজন যেমন এক দেশ কালের নিরিখে চিহ্নিত তেমনই তার স্ব-জাতির সাথে মুখোমুখি হওয়ার এক দিক নির্দেশ। কোথাও গুছিয়ে তোলা তার ঘরকে...মুলুককে...দেশকেও। কোথাও কতক গুলো প্রশ্নর উত্তর তাকে দিতেই হয়...কোথাও সে প্রশ্ন তৈরী করে...। ৯/১১ এর প্রেক্ষাপটে গল্প বুনতে বসে তাই কোথাও যেন পরিচালককে আমেরিকার পালা পরিবর্তনের জন্যও অপেক্ষা করতে হয়। আনতে হয় নতুন নির্বাচন...নতুন এফ্রো-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট।

 
বহুদিন পরে শাহরুখ আর কাজলের জুটি আবার এক ঝলক নতুন ভালোলাগা জমায় দর্শকের মনে।
কাজল এই ছবিতে অনবদ্য।
নীতি শিক্ষার এই সংলাপ হাত তালি জোগাবে...এবং জানাবে প্রণতি...আজকাল হিট ছবির ইতিহাস শুনলেই ...তার প্রেক্ষাপট দেখলে আমার কেমন যেন নীতি শিক্ষার বই গুলোর কথা মনে পড়ে।

 
তবু যেন এইসব কিছু থেকে অনেক দিন আগে...অনেকদূরে...বিগ বাজেটের রুপকথার গল্পকে না ছুঁয়ে...আমার বন্ধু বিক্রম  পিডি ওয়ান ফিফটিতে একটা ছবি বানিয়েছিলো। প্রেক্ষাপট ছিলো কলকাতা। ছবির নাম লাদেন ইজ নট মাই ফ্রেন্ড। ২০০৩ সালের  এই শহর কলকাতার এক বাঙালী মুসলিম পরিবারের ছেলে আফতাব স্বপ্ন দেখে আমেরিকা যাওয়ার। গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে পড়া আর কাজ করার ইচ্ছে তার মনে। কিন্তু বাদ সাধে ৯/১১। নিরুপদ্রব শহর কলকাতায় কোথাও যেন চলতে থাকে গুন-গুন ফিসফাস শব্দ। কোথাও যেন একা হতে থাকে আফতাব...তার স্বপ্নগুলোকে নিয়ে...এক সময় তার মনে হয় লাদেন যেন তার পিছু নিয়েছে এই কলকাতায়...এই শহরে...এই সখেদ নির্জনতায়।
 
ছবির শুরুই ছিলো আফতাব আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে চিঠি লিখছে। “Respected Sir…My name is Aftab Haque…I am a Muslim… A Bengali Muslim…” প্রায় তিরিশ মিনিটের এই ছবিটা একটা চিঠির বয়ান। একটা অতি সাধারণ...এক বাঙালী ছেলের সাধ পূরণের ইচ্ছা...অনিচ্ছা...তার ভয়...হারিয়ে যাওয়ার দুর্বলতা...ছবির পরতে পরতে...। শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পারি না আফতাব তার চিঠির উত্তর পেয়েছিলো কিনা...রিজওয়ানের মতো প্রেসিডেন্ট তাকে সম্ভাষণ করেছিলো কিনা।

আমরা শুধু দেখেছিলাম রাতের আঁধার...কলকাতার রাতের যানবাহন...তার নিয়ন আলো...তার সাড়ে তিনশো বছরের হাড় পাঁজর করা জ্বরা জীর্ণ ইতিহাসের মধ্যে কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে  আফতাব...কোথাও যেন সব কিছুকে ছাড়িয়ে জেগে উঠছে তার কমপিউটারের কি প্যাডের শব্দ...
ছবিটা শেষ করেছিলেন বিক্রমজিত...
তাঁর বন্ধুরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ছবিটির কাজে...উতসাহে...উদ্দীপনায়...
অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন মোনাজ আফতাবের ভূমিকায়...
ছবিটি সে বছর কেরালার চলচ্চিত্র উতসবে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারও পেয়েছিল।
ছবির নির্মাতা আর কুশীলবরা পেয়েছিলেন বাহবা।
সেন্সর সার্টিফিকেট না থাকায় সেবার মুম্বাই ইন্টারন্যাশানাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ছবিটা অন্তর্ভূক্তি হয়নি। কিন্তু তাতেও দমে থাকেননি উদ্যোক্তারা...দেখানো হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়...ব্রিটিশ কাউন্সিলের হাত ধরে ঘুরেছে সারা ভারত। পরে বিদেশের কেউ কেউ দেখেছেন।
এর থেকে খুব একটা বেশি কিছু হয়নি ছবিটাকে ঘিরে।
তার আশাও করেনি কেউ।
কারণ ওই যে আফতাবের পিছনে ছিলো না একটা দামী রুকস্যাক...
আফতাবের পিছনে ছিলো না বহুজাগতিক সংস্থাগুলি...
আফটার অল আফতাব সত্যিই একজন সাধারণ মানুষ...
কাজেই তার যাত্রাটা কী করে Extraordinary হবে?
তবু যেন ইতিহাস হাসে...
সময়ের ভাস্কর্যে...
এক ছোট্ট ছবির প্রচ্ছায়া বহন করে একটা বড় ছবি...
 বহু দিন পরে...
আফতাবের খোয়াবনামা উড়তে থাকে রিজওয়ানের অন্তরে...।
 

মন্তব্যসমূহ

  1. দেখেও ফেললি ছবিটা ঃ) ...আমি কবে দেখব জানিনা... তবে একদম ঠিক লিখেছিস তুই... আমি যেদিন থেকে টিভিতে এই ছবির প্রোমো দেখছি, সেদিন থেকেই আমার বিক্রমের ছবিটার কথা মনে পড়ছে...বিশেষ করে ওই প্রেসিডেন্ট কে চিঠি লেখা, আর একটা লাইন- I am a muslim, I am not a terorrist...এটা কি হিন্দিতে আছে?...এই দুটোই মনে পড়িয়েছে বিক্রমের ছবিকে...

    এই ছবির মধ্যে কি খানিকটা FORREST GUMP এর ছায়াও আছে? ওই ভালোবাসার জন্য দৌড় দেখে মনে হল...

    উত্তরমুছুন
  2. "লাদেন ইজ নট মাই ফ্রেন্ড" ছবিটা দেখি নি। আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, "মাই নেম ইজ খান"-এ অনেকটাই ছায়া আছে অই ছবির! অনলাইনে খুঁজে দেখি ছবিটা পাওয়া যায় কিনা।

    আপনার গদ্য দারুণ সাবলীল...গল্পটল্প লেখা হয়না?
    ভালো এবং সুন্দর থাকুন!
    শুভেচ্ছা!

    উত্তরমুছুন
  3. মহাশ্বেতা...ফরেস্ট গাম্পের ছায়া তো আছেই। ছবিটা পারলে দেখে নিস।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি